দিনাজপুরের ফুলবাড়ির মেয়ে আয়েশা সিদ্দিকা। যিনি দেশের প্রথম নারী কাজী বা নিকাহ রেজিস্ট্রার হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আদালতের নিষেধাজ্ঞায় আপাতত সে পথে বিঘ্ন তৈরি হয়েছে।
তবে দমে যান নি আয়েশা সিদ্দিকা। লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।
কে এই আয়েশা সিদ্দিকা?
গত প্রায় ১৯ বছর ধরে দিনাজপুরে ফুলবাড়ী উপজেলার পূর্ব কাটাবাড়ীতে হোমিও চিকিৎসক হিসেবে কাজ করছেন আয়েশা সিদ্দিকা।
এলাকায় চিকিৎসক হিসেবে সুনামও আছে তার। এখনো তিনি সপ্তাহে চারদিন রোগী দেখেন।
৩৯ বছর বয়সি আয়েশা ফুলবাড়ীর দারুল সুন্নাহ সিনিয়র সিদ্দিকিয়া মাদ্রাসা থেকে ফাজিল পাস করেন৷
এই হোমিও চিকিৎসক আয়েশা সিদ্দিকাই হতে চেয়েছিলেন দেশের প্রথম নারী কাজী বা নিকাহ্ রেজিস্টার।
হোমিও চিকিৎসক থেকে কাজী হওয়ার পথে আয়েশা
২০১২ সালে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে ফুলবাড়ী পৌরসভায় নিকাহ রেজিস্টার বা কাজি পদের জন্য আবেদন করেন আয়েশা সিদ্দিকা।
নিয়োগ বিজ্ঞাপনে কেবল পুরুষ সদস্য আবেদন করতে পারবেন, এমন কোন কথা লেখা ছিল না।
ধাপে ধাপে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা দিয়ে ২০১৪ সালে নিয়োগ পরীক্ষায় তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন।
নিয়োগ প্রক্রিয়া চূড়ান্তে গঠিত কমিটির সদস্য ছিলেন স্থানীয় সংসদ সদস্য, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়রসহ মোট পাঁচজন।
ওই কমিটি নির্বাচিত তিনজন সদস্যের একটি প্যানেল প্রস্তাব দিয়ে চূড়ান্ত করে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছিল।
এরপর মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি দিয়ে কমিটির কাছে জানতে চাওয়া হয়, তারা কাকে নিয়োগ দিতে চান।
সেসময় কমিটি চিঠি দিয়ে আয়েশা সিদ্দিকাকে নিয়োগের সুপারিশ করে।
কিন্তু কয়েকমাস পরে আয়েশাকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছিল যে নিয়োগ কমিটির প্রস্তাবিত প্যানেল বাতিল করে দিয়েছে আইন মন্ত্রণালয়।
আয়েশার আদালতে আসা
২০১৪ সালের ১৬ জুন আইন মন্ত্রণালয় ‘বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নারীদের দ্বারা নিকাহ্ রেজিস্টারের দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়’ – এমন মত দিয়ে একটি চিঠি দিয়ে নিয়োগ কমিটির প্রস্তাবিত প্যানেল বাতিল করে।
এই চিঠি পেয়ে আয়েশা প্রথমে মনঃক্ষুণ্ণ হলেও মেনেই নিয়েছিলেন বিষয়টি।
কিন্তু এরমধ্যে আয়েশা হঠাৎ জানতে পারলেন, প্যানেলের প্রস্তাবিত তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে থাকা ব্যক্তিকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে, যিনি একজন পুরুষ এবং সম্পর্কে তার আত্মীয়।
এই ঘটনায় আয়েশা অপমানিত বোধ করেন। কারণ তিনি জানেন, পরীক্ষায় প্রথম হয়েও তিনি নিয়োগ পাচ্ছেন না শুধু নারী হওয়ার কারণে!
পরে তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন। ঢাকায় আসেন প্রতিকারের আশায়। এরপরই আইন মন্ত্রণালয়ের ঐ চিঠিকে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন আয়েশা সিদ্দিকা।
ছয় বছর পরে ২০২০ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি আদালত মন্ত্রণালয়ের মতামতকে বহাল রেখে রায় দেয়। সম্প্রতি ১০ই জানুয়ারি পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়, আর তারপরই বিষয়টি সবার সামনে চলে আসে।
বিষয়টি নিয়ে দেশের গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা চলছে এখনো।
আদালতের রায়
রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে যে কিছু নির্দিষ্ট শারীরিক ও সামাজিক বাস্তবতার কারণে দেশের নারীরা নিকাহ্ রেজিস্টার বা কাজি হতে পারবেন না।
আয়েশা বলছেন, পূর্ণাঙ্গ রায় এখন প্রকাশিত হলেও, ২০২০ সালে আদালতের রায়ের পরই তিনি আপিল করা সিদ্ধান্ত নেন।
ইতিমধ্যে অ্যাপিলেট ডিভিশনে এ নিয়ে একটি আপিল দায়ের করা হয়েছে।
৯০ নাগরিকের প্রতিবাদ
বাংলাদেশের হাইকোর্ট ‘নারী বিয়ের কাজী হতে পারবে না’- মর্মে দেওয়া রায়ের প্রেক্ষিতে ৯০ জন ‘সাধারণ নাগরিক’ প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
বুধবার পাঠানো এক প্রতিবাদলিপিতে তারা জানান, হাইকোর্টের এমন নির্দেশনার খবরে আমরা সাধারণ নাগরিক অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়েছি। হাইকোর্টের এমন নির্দেশনা কোনোভাবেই ন্যায্য ও সংবিধানসম্মত নয় বলে আমরা মনে করি। এ নির্দেশনা একচ্ছত্র পুরুষাধিপত্য দুষ্ট এবং অনেকাংশেই পশ্চাৎপদ ধারণার অনুবর্তী।
এতে বলা হয়, আমাদের বাংলাদেশের সংবিধান নারী, পুরুষসহ সকল জেন্ডার, সকল ধর্মের এবং সকল বর্ণের সমঅধিকার ও মর্যাদার সুরক্ষা দিয়েছে। কিন্তু এ নির্দেশনা পুরোপুরিই সেই সাংবিধানিক নীতিকে ভূলুণ্ঠিত করেছে।
এতে বলা হয়, বিয়ে এবং রেজিস্ট্রেশন ভিন্ন। মুসলমানদের বিয়ে হয় মুসলিম আইনে আর মুসলিম আইন অনুযায়ী বিয়ে একটি চুক্তি। রেজিস্ট্রেশন হয় রাষ্ট্রীয় আইনে। এই রেজিস্ট্রেশনের দায়িত্ব পালন করার জন্য মসজিদে যাওয়া আবশ্যক নয়, এমনকি বিয়ে করার জন্যও নয়।
যেহেতু রেজিস্ট্রেশনের কাজ একটি রাষ্ট্রীয় আইনি দায়িত্ব সেহেতু এ দায়িত্ব মুসলিম এমনকি যেকোনো ধর্মের নারী-পুরুষ উভয়ের করার অধিকার রয়েছে। কারণ সরকারি কাজে নিয়োগের ক্ষেত্রে সংবিধানের ২৯ (২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কেবল ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী, নারী পুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের অযোগ্য হবে না, কিংবা সে ক্ষেত্রে তার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাবে না। সরাসরি বিয়ে পড়ানো সরকারি কাজ না হলেও, বিয়ে পড়ানোর যে লাইসেন্স অর্জন করতে হয় তা রাষ্ট্রীয়ভাবেই অর্জন করতে হয়। সেই অর্জনে নারী-পুরুষের লৈঙ্গিক পরিচয় কোনো বাঁধা নয়।
পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে হাইকোর্টের নির্দেশনায় বিশেষভাবে বলা হয়েছে, নারীদের প্রতি মাসে মাসিক হয় বলে তারা বিয়ে পড়ানোর জন্য উপযুক্ত না। কিন্তু বিয়ের নিবন্ধন অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় একটি আইনগত কাজে মাসিক কোন বাধা হতে পারে না। এই মাসিক নিয়েই আমাদের দেশের প্রতিটা নারী সরকারি-বেসরকারি কাজ করছে এবং মাসিক একটি নারীর স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় ঘটনা; যা নারীকে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তৈরির জন্য সক্ষম করে তোলে। মাসিকের দোহাই দিয়ে এই নির্দেশনা প্রকৃতপক্ষেই নারীর দেশ এবং সমাজের প্রতি অবদানকে অস্বীকার করা হয়েছে। যে দেশে প্রধানমন্ত্রীর আসনে একজন নারী, স্পিকার হিসেবে একজন নারী দায়িত্ব পালন করছে, সেই দেশে মাসিকের জন্য একজন নারী কেন বিয়ের কাজীর দায়িত্ব পালন করতে পারবে না?