ফারহান হাবীব,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর দিয়ে মেট্রোরেল যাওয়ার বিরোধিতা করে বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে যখন আন্দোলন চলছিলো তখন সাধারণ শিক্ষার্থী ব্যানারে মেট্রোরেলের পক্ষে অবস্থান নেয় ছাত্রলীগ। বরাবরের মতো হল পলেটিক্সের কারণে বাধ্য হয়েই সাধারণ শিক্ষার্থীদের ছাত্রলীগের সেসময়ের কর্মসূচিতে থাকতে হয়েছে। সেসময় একটা ব্যানারের বক্তব্য খুব চোখে লেগেছিলো। ব্যাপারটা নিয়ে ব্যাপক হাসাহাসিও হয়েছিল তখন। যেখানে লেখা ছিলো, যুক্তি দিয়ে মুক্তি মেলে না। তারপর পানি অনেক দূর গড়ায়। এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ভিতর দিয়ে মেট্রোরেল তৈরির কাজ প্রায় শেষ।
মজার বিষয় হলো, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এধরণের হাস্যকর কাউন্টার প্রোগ্রাম দেখলেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব দেখা যায়নি এতদিন। গত ১০ বছর ধরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু পাল্টাপাল্টি দুই গ্রুপ দেখা যায়নি। বরং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাবেক শিক্ষার্থী হিসেবে আমি বলবো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চাইতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে একতাবদ্ধ থাকার চেষ্টাই দেখেছি সব সময়। যার উদাহরণ ভ্যাট বিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলন। কিন্তু বিগত সব রেকর্ড ভেঙে ইউল্যাবের একদল শিক্ষার্থী নতুন উদাহরণ তৈরি করেছে। করোনার আর্থিক ক্ষতির কারণে ৫০% বেতন মওকুফের আন্দোলনের বিপরীতে একদল শিক্ষার্থীকে দেখা গিয়েছে এইতো গেলো কয়দিন ধরে।
ইউল্যাবের এই আন্দোলন গত এক মাসের বেশি সময় ধরে চলছে। শান্তিপূর্ণ এই আন্দোলনে আন্দোলনকারীরা বারবার ইউল্যাব প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনায় বসে তাদের ন্যায্য দাবি তুলে ধরেছে। কিন্তু ইউল্যাব প্রশাসন বারবার তাদের দাবির বিন্দুমাত্র বাস্তবায়নেরও ইচ্ছা দেখায়নি। বরং শুরুর দিকে আন্দোলনের প্রধান দুই নেতা সাদাত মাহমুদ ও রায়হান আতিককে আন্দোলন বন্ধ করলে তাদের ‘প্রয়োজনীয় ওয়েভার দেয়ার প্রলোভন’ দেখায়। কিন্তু নিজেদেরে দাবির প্রতি অনড় দুই আন্দোলনকারী আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। আর এতেই ইউল্যাব প্রশাসনের আঁতে ঘা লাগে।
মূলত সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ক্লাবগুলোর প্রেসিডেন্ট সেক্রেটারি যেভাবে তাদের কথা শোনে তারা ভেবেছিলো সাদাত এবং রায়হান একইভাবে তাদের প্রলোভনে পড়বে। কিন্তু সেটি না হওয়ায় এরপর তারা বহিস্কারের হুমকি দেয় এবং পরবর্তিতে তাদের বহিস্কারও করে। এই বহিস্কারের কারণে আন্দোলন আরো বেগবান হলে তারা নেমে পড়ে আন্দোলনকারীদের নানাভাবে হেয় করতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ক্লাব, অ্যালামনাই এসোসিয়েশন, শিক্ষক ইত্যাদি দিয়ে তারা মিথ্যা প্রচার প্রচারণা চালানো শুরু করে। সব শেষ এসে তাদের নামে মামলা করে। যেই মামলায় সাদাত এবং রায়হানকে নিজ ক্যাম্পাসের সামনে থেকে আন্দোলনরত অবস্থায় পুলিশ নির্মম নির্যাতনের মাধ্যমে তুলে নিয়ে যায়।
ঘটনা এ পর্যন্তও ব্যক্তিগতভাবে মেনে নিলাম এই ভেবে যে, সরাসরি লুটেরা ধণিক শ্রেণী অথবা লুটেরা ধণিক শ্রেণীর পৃষ্ঠপোষকতা করা রাষ্ট্রের সঙ্গে বিবাদে জড়ালে পরিণতি কখনো শুভ হয় না। সাদাত এবং রায়হানেরও তাই হয়েছে। কিন্তু মজার বিষয় হলো, সাদাত এবং রায়হানকে গ্রেপ্তারের ঠিক পরপরই ইউল্যাবে ‘যুক্তি দিয়ে মুক্তি মেলে না’র প্রাইভেট বা ইউল্যাব ভার্সনের দেখা পেলাম। যেই মুহূর্তে দেশের বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সব শিক্ষার্থী আন্দোলন করে করোনার আর্থিক ক্ষতির কারণে তাদের বেতন মওকুফের জন্য আন্দোলন করছে, এমনকি আন্দোলন করে সফলও হচ্ছে সেই মুহূর্তে ইউল্যাবের একদল শিক্ষার্থীকে দেখলাম তারা বেতন মওকুফের যৌক্তিক আন্দোলনের বিরোধিতা করছে। তাদের সঙ্গে যুক্ত আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম সর্বস্ব অ্যালামনাই এসোসিয়েশন এবং কয়েকজন শিক্ষক।
অবাক লাগলেও সত্য যে, এই করোনায় আর্থিকভাবে চারিদিকে যে হাহাকার শুরু হয়েছে তাতে জনজীবনে প্রাণের সঞ্চার নেই। যতই দিন যাচ্ছে ততই মানুষের ভেতরের আতংক যেন বেড়েই চলেছে। যদি ধরেও নেই এখন সব স্বাভাবিক তারপরও বলতে হয় লম্বা সময়ের দেশে বিদেশের লকডাউন পরিস্থিতির কারণে যে আর্থির ক্ষতি হয়েছে সেটি ক’জন কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। ফলে সাদাতরা কী খুব অযৌক্তিক দাবি তুলেছে। আচ্ছা সাদাতরা খুব জঘন্য সব কাজ করেছে। কিন্তু আমার প্রশ্ন, বহিস্কারের আগে কি এ ধরণের একটি কাজও তারা করেছে যেগুলোকে আমরা ধ্বংসাত্মক বলতে পারি। সাদাতের শরীর থেকে যে রক্ত বেরিয়েছে তখন কী ‘যুক্তি দিয়ে মুক্তি মেলে না’র ইউল্যাব ভার্সন একটা কথা বলেছে? কিংবা তারও আগে, মানে বহিস্কারের সময়? একটা বিশ্ববিদ্যালয় তার শিক্ষার্থীকে প্রতিপক্ষ কীভাবে বানাতে পারে এটা কি আমরা বলতে পারি?
এই লেখার মূল উদ্দেশ্য হলো, আমাদের তরুণদের মধ্যে জন্ম নেয়া দাসত্বের প্রতি ভালোবাসা দেখে। তারুণ্যের উচ্ছ্বল দিক নিয়ে নানা কথাই হয়। কিন্তু সব সময় সুশাসন চাওয়া, অন্যায় দেখলে ফেসবুকে বিরাট আওয়াজ তোলা এসব মোরাল পুলিশদের একটা বিরাট অংশই কিন্তু আমাদের আগের প্রজন্মগুলোর মধ্যে থাকা সুবিধাভোগীদের মতোই আচরণ করছে। অর্থাৎ রাজাকার যুগে যুগেই থাকে।
‘যুক্তি দিয়ে মুক্তি মেলে না’র ঢাবি ভার্সনে অনেক শিক্ষার্থী কেবল হলে থাকতে হলে ‘ভাইদের’ কথা শুনতে হবে, এই কারণে সেই সমাবেশে গেছে। কিন্তু ইউল্যাবের যেসব শিক্ষার্থী তার বন্ধুদের বহিস্কার, হামলা ও মামলার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে গিয়ে ধোয়া-মোছা আর আন্দোলনের বিরুদ্ধে ব্যানার ফেস্টুন নিয়ে দাঁড়ায় তখন মনে প্রশ্ন জাগে, এরা আসলে কিসের লোভে এই কাজটা করেছে? এদের তো কোন ‘ভাই’ নেই, নেই গেস্টরুম কালচার। তখন একটা কথাই মনে হয়, তরুণদের সবাই মেরুদন্ড নিয়ে জন্ম নেয় নাই। যুগে যুগে তাই হয়েছে। ২০২০ সাল সেটাই স্মরণ রাখবে। তোমাদের স্মরণ রাখবে আন্দোলনকারী সাহসী তারুণ্য। সবশেষ, ইতিহাস তৈরি করা এইসব আন্দোলনকারীদের লাল সালাম।
লেখক: সাংবাদিক ও সাবেক ছাত্রনেতা।