‘আমি কোন পার্টির নাম বলছি না, কোন নেতার নাম বলছি না…. কেউ যদি আমার আব্বার ভাস্কর্য স্থাপন করে, সর্বপ্রথম আমি আমার আব্বার ভাস্কর্যকে ছিঁড়ে, টেনে-হিঁচড়ে ফেলে দেব।’
গতকাল (২৭ নভেম্বর) শুক্রবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রামের হাটহাজারী পার্বতী উচ্চবিদ্যালয় মাঠে আয়োজিত এক মাহফিলে প্রধান অতিথির বক্তব্যে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির জুনায়েদ বাবুনগরী এ হুমকি দেন।
অপরদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেুতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের মন্তব্য করে বলেন, বাংলাদেশের স্থপতির ভাস্কর্য টেনে হেঁচড়ে নামাবে বলে কোন কোন ধর্মীয় নেতা ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য রাখছেন, তাদের এমন রুচি এবং ভাষা ব্যবহার দেখে তাদের ধর্মচর্চা ও ইসলামি রুচিবোধ নিয়ে জনমনে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।
আজ (২৮ নভেম্বর) শনিবার সকালে সংসদ ভবনস্থ তার সরকারি বাসভবনে সমসাময়িক বিষয় নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ মন্তব্য করেন।
২০১৪ সালে এক বক্তৃতায় শেখ হাসিনা বাংলাদেশে মদিনা সনদ বাস্তবায়ন করা হবে বলে যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, সেই বক্তব্যের কথা মনে করিয়ে দিয়ে জুনাইদ বাবুনগরী বলেন, ‘মদিনা সনদে যদি দেশ চলে, তাহলে কোন ভাস্কর্য থাকতে পারে না’।
এ কদিন বাংলাদেশে মামুনুল হক নামে একজন ইসলামী নেতার ভাস্কর্য-বিরোধী অবস্থান উত্তাপ ছড়াচ্ছিল, যার সর্বশেষ সংযোজন হিসেবে চট্টগ্রাম ও ঢাকায় শুক্রবার ভাস্কর্যের পক্ষে-বিপক্ষে কিছু বিক্ষোভ দেখা যায়।
ঢাকায় বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশকে বলপ্রয়োগও করতে হয়।
এরকম পরিস্থিতিতে চট্টগ্রামে পূর্বনির্ধারিত একটি ইসলামিক অনুষ্ঠান বা ওয়াজ মাহফিলে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরতও থাকেন মামুনুল ইসলাম, যিনি নিজে হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব।
২০১৪ সালে এক বক্তৃতায় শেখ হাসিনা বাংলাদেশে মদিনা সনদ বাস্তবায়ন করা হবে বলে যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, সেই বক্তব্যের কথা মনে করিয়ে দিয়ে ওই সমাবেশে জুনাইদ বাবুনগরী বলেন, ‘মদিনা সনদে যদি দেশ চলে, তাহলে কোন ভাস্কর্য থাকতে পারে না’।
‘মদিনা সনদে যদি দেশ চলে, ইসলামবিরোধী কোন কাজ হতে পারবে না… ইনশাআল্লাহ প্রধানমন্ত্রী দেবে না, দেবে না। কারণ উনি নিজে ঘোষণা করেছেন মদিনা সনদে দেশ চলবে।’
তবে তিনি এও বলেন, তিনি বা তার সংগঠন কোন রাজনৈতিক সংগঠন নয়, তারা সরকার বা প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধেও নয়।
এদিকে সাংবাদিক আজকের সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য স্থাপন নিয়ে একটি ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী অনাহুত বিতর্কের সৃষ্টি করছে বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেুতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
ওবায়দুল কাদের বলেন, একজন ধর্মপ্রাণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন সরকার পরিচালনার দায়িত্বে তখন এদেশে ইসলাম বিরোধী কোন কার্যক্রম হবে, তা বিশ্বাস করার কোন কারন নেই।
তিনি বলেন, ভাস্কর্যকে যারা মূর্তি বলে অপপ্রচারে নেমেছে তারা নিজেরাই ভ্রান্তিতে আছে, দেশের আলেম সমাজ এবং বিশেষজ্ঞগণ ইতিমধ্যেই বারবার বলেছেন মূর্তি আর ভাস্কর্য এক নয়।
জুনায়েদ বাবুনগরী ওই সভায় আরো বলেন, ‘বর্তমান পুরো বিশ্বে আস্তিক আর নাস্তিকের লড়াই চলছে। আওয়ামী লীগ-বিএনপির মধ্যে কোনো লড়াই নেই, শুক্রবারের জুমার নামাজে তারাও পাশাপাশি দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পরস্পরের মধ্যে আত্মীয়তার বন্ধন হয়, মুসলমান হিসেবে সবাই ভাই ভাই। কিন্তু আস্তিক আর নাস্তিক কখনো এক হতে পারে না।’
যদিও এ ব্যাপারে আওয়ামীলীগ সাধারণ সম্পাদকের সুস্পষ্ট কোন মন্তব্য পাওয়া যায় নি।
বিতর্কের সূত্রপাত-
প্রায় দুই মাস ধরে ঢাকার ধোলাইপাড় চত্বরে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের একটি ভাস্কর্য তৈরি করার পরিকল্পনার বিরোধিতা করে আসছিল অনেকগুলো ইসলামপন্থী দল।
অক্টোবরের শুরু থেকেই ভাস্কর্য তৈরির প্রতিবাদে বেশ কয়েকটি দল ঢাকার কয়েকটি জায়গায় প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ করেছে।
কিন্তু খেলাফত মজলিশের নেতা মামুনুল হক গত তেরই নভেম্বর ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে শেখ মুজিবর রহমানের ভাস্কর্য তৈরির তীর্ব্র সমালোচনা করেন। পনেরাই নভেম্বর এক সম্মেলনে হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব নির্বাচিত হন মি. হক।
তিনি সরকারকে হুঁশিয়ার করে বলেছিলেন, ভাস্কর্য নির্মাণ পরিকল্পনা থেকে সরে না দাঁড়ালে তিনি আরেকটি শাপলা চত্বরের ঘটনা ঘটাবেন এবং ওই ভাস্কর্য ছুঁড়ে ফেলবেন। তার ওই বক্তব্য সরকারি দল আওয়ামী লীগে অস্বস্তি তৈরি করে।
এরপর আওয়ামী লীগ আনুষ্ঠানিকভাবে কোন প্রতিক্রিয়া না দেখালেও দলটির সাধারণ সম্পাদক বলেছিলেন, তারা বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছেন।
এরপর দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছাত্রলীগ ও যুবলীগ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে শুরু করে মামুনুল হকের বিরুদ্ধে।
ঢাকায় ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয়ভাবেও সামবেশ করে ভাস্কর্যের বিরোধীতাকারীদের উচিৎ জবাব দেবার হুমকি দিয়েছে।
এর ধারাবাহিকতায় বৃহস্পতিবারই চট্টগ্রামে জঙ্গিবাদবিরোধী সমাবেশ থেকে মামুনুল হকের কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয় এবং শুক্রবার তাকে চট্টগ্রামে প্রতিরোধের ঘোষণা দেয়া হয়।
ঘোষণা অনুযায়ী শুক্রবার চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় প্রতিবাদ, বিক্ষোভ, সড়ক অবরোধসহ নানা কর্মসূচী পালিত হয়েছে।
এই কর্মসূচীর জবাবে ঢাকায় ইসলামপন্থীরা একটি বিক্ষোভ দেখালে তা ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ।
জুনায়েদ বাবুনগরী শুক্রবার সন্ধ্যায় এক ঘন্টারও বেশি সময় ধরে দেয়া বক্তব্যে মূলত ভাস্কর্য ইস্যু নিয়েই কথা বলেন। এছাড়া আস্তিক-নাস্তিক বিতর্ক, বয়কট ফ্রান্স এবং কাদিয়ানি ইস্যু নিয়েও কথা বলেন।
তিনি বক্তব্য শেষ করেন, যারা গতকাল মামুনুল হকের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখিয়েছে তাদেরকে অভিসম্পাত দেয়ার মধ্যে দিয়ে।
বাংলাদেশে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে এর আগেও ভাস্কর্য তৈরির বিরোধিতা এবং ভাস্কর্য অপসারণের দাবি এসেছে।
তিন বছর আগে ২০১৭ সালে ঢাকায় সুপ্রিমকোর্ট চত্বরে গ্রীক দেবীর আদলে একটি ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছিল। হেফাজতে ইসলামসহ ইসলামপন্থী কয়েকটি সংগঠনের বিরোধিতার মুখে সেই ভাস্কর্য সেখান থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছিল।