মোহাম্মদ শাহ আলম :
গত ১ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন, ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছে, দুইটি নির্বাচনের কৌশল ছিল ভিন্ন, এক ধরণের নয়। ২০১৮-এর জাতীয় নির্বাচনে ৩০ ডিসেম্বরের ভোটে ২৯ ডিসেম্বর নৈশকালে ভোট বাক্স ভর্তি হয়ে যায়। আর ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ভোটার যত কম আসে তার এবং ভোটারকে সহযোগিতার নামে ভোট দিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। নির্বাচনে এ রকম অনিয়মের কারণে মানুষ ভোট প্রয়োগে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের ভোট প্রয়োগের শতকরা হার ছিল খুবই কম। এ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে শাসক দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়েদুল কাদের এটাকে অশনিসংকেত বলেছেন। আসলেই এটা অশনিসংকেত। এর ফলে রাজনৈতিক শুন্যতা সৃষ্টি হচ্ছে। এটা গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য শুভ নয়।
পাকিস্তান আমল থেকে গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করছে বাঙালিরা। কিন্তু গণতন্ত্র ও গণমানুষের বিজয়ের পর শাসক শোষক দেশি-বিদেশি কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠী ও জনগণের অধিকার হরণকারীরা ষড়যন্ত্র করেছে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের ধ্বস নামানো বিজয়ের পর রাজনৈতিক শক্তি ও দলের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি, আদমজী, চন্দ্রঘোনা পেপার মিলে বাঙালি বিহারী দাঙ্গা, ক্ষমতার মোহ, স্বায়ত্তশাসনের ওয়াদা থেকে সরে যাওয়া, সবই ষড়যন্ত্রের অংশ। আওয়ামী লীগের ভাঙন, ন্যাপ গঠন, যুক্তফ্রন্টের ব্যর্থতা, জেনারেল আইয়ুবের সামরিক অভ্যুত্থান, সামরিক শাসন জারি, ১৯৬২ সালে আইয়ুবের অভিনব গণতন্ত্র, অপ্রত্যক্ষ মৌলিক গণতন্ত্র চালু, ৮০ হাজার বি.ডি. মেম্বার দিয়ে নির্বাচনী ব্যবস্থা, সবগুলিই গণতন্ত্র বিরোধী জনবিচ্ছিন্ন কলা কৌশল। শাসক-শোষক, কায়েমী স্বার্থবাদী শ্রেণি গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার কৌশলগত ব্যবস্থা। তাই মৌলিক গণতন্ত্র ও শিক্ষা সংকোচনের বিরুদ্ধে ৬২-র ছাত্র আন্দোলন, ৬৬-র ছয় দফা, ৬৯-র ১১ দফা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, আইয়ুব স্বৈরাচারের পতন, জেনারেল ইয়াহিয়ার ক্ষমতা গ্রহণ, ৭০-র নির্বাচনে বাঙালির বিজয়, সমাজ ও রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক শক্তির উত্থান ও বিকাশ। প্রতিটি লড়াই ছিল শাসক-শোষক দেশি-বিদেশি কায়েমী স্বার্থবাদীদের সাথে সাংঘর্ষিক। ফলে শুরু হয় ৭০-র বাঙালির ঐতিহাসিক বিজয় ছিনতাইয়ের ষড়যন্ত্র। ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও অসহযোগ আন্দোলন, সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা অর্জন, দেশি-বিদেশি শাসক-শোসক গোষ্ঠী ও শ্রেণির পরাজয়, গণমূখি অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণ। প্রগতির ধারার সূচনা, ফলে প্রগতি ও প্রক্রিয়াশীল শক্তির মধ্যে নতুন দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। নতুন করে দেশি-বিদেশি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সামাজিক-রাজনৈতিক নতুন বিন্যাস, জনগণের বিজয় ছিনতাইয়ের নব ষড়যন্ত্র শুরু হয়। ১৯৭৫ এ সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ড। রাজনৈতিক পটপরিবর্তন। পাকিস্তানি আমলের পুঁজিবাদী সামাজিক অর্থনেতিক ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পুনঃপ্রতিষ্ঠা, জনগণের বিজয় ছিনতাই। জিয়া এরশাদের সামরিক শাসন। সামরিক শাসনবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন। ৯০-এ স্বৈরাচারের পতন, গণতন্ত্রের বিজয়। গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার লড়াইয়ের এটাই হলো ইতিহাস। তাই এটা পরিস্কার জনগণের বিজয় ও গণতন্ত্রের সাথে শোষক লুটেরাদের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা ও নীতির দ্বন্দ্ব পরস্পর বিরোধী। এই কারণে গণতন্ত্র বার বার হারিয়ে যায়। জনগণ বুকের রক্ত দিয়ে বিজয়, অধিকার, গণতন্ত্র কায়েম করে। গণবিরোধী ধনিক শ্রেণি গণতন্ত্র হরণ করে।
১৯৫৪ যুক্তফ্রন্টের বিজয়, ১৯৭১’র মুক্তিযুদ্ধের বিজয় যেমন কায়েমী শাসক-শোষক নসাৎ করেছে, নীতির পরিবর্তন না হওয়ার ফলে আমরা দেখি ১৯৯০ এর এরশাদ স্বৈরাচার পতনের বিজয়, দেশি-বিদেশি শাসক লুটের’রা আত্মসাৎ করেছে এবং নিয়ন্ত্রণ করছে। এমন গণতন্ত্র বর্তমানে তারা চালু রেখেছে যাতে তাদের শ্রেণি স্বার্থ হুমকিগ্রস্ত না হয়।
জেনারেল জিয়াউর রহমান যে পুঁজিবাদী লুটপাটের অর্থনীতি চালু করেছিল, আমরা জানি এরশাদ তাকে অবাধ করেছে। সেই লুটপাটের অর্থনীতির চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বর্তমান আওয়ামী লীগ। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন নেতারা বলছেন উন্নয়ন চান না গণতন্ত্র চান। মানুষ উন্নয়নও চায়, গণতন্ত্রও চায়। উন্নয়নের সাথে গণতন্ত্রের কোনো বিরোধ নেই। উন্নয়ন ও গণতন্ত্র পরস্পরের পরিপূরক। হ্যাঁ লুটপাটের উন্নয়নের সাথে গণতন্ত্রের দ্বন্দ্ব আছে। লুটপাটের উন্নয়নের সাথে জনগণ ও গণতন্ত্রের স্বার্থ সাংঘর্ষিক। কারণ গণতন্ত্র থাকলে জবাবদিহি করতে হয়, কর্মকাণ্ড নিয়ম মেনে করতে হয়। ফলে আমলা লুটেরাদের পছন্দ গণতান্ত্রিক শাসন নয়, স্বৈরশাসন। তাই গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হয়। এদেশে গণআন্দোলনে গণতন্ত্র আসে-গণবিরোধী শক্তির ষড়যন্ত্রে গণতন্ত্রের পতন হয়।
১৯৭৫-এর পর থেকে যে লুটেরা শাসকশ্রেণি ক্ষমতা দখল করে বসে আছে- তাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণেও গণতন্ত্র-গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও অধিকার সংকুচিত, নিয়ন্ত্রিত হয়। তাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব সামাল দেওয়ার জন্য প্রচলিত লুটেরা ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য রাজনৈতিতে ওয়ান ইলেভেনের ন্যায় নানা ঘটনা ও কৌশল আমরা প্রত্যক্ষ করি।
বস্তুত: গণতন্ত্রবিরোধী কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র, শাসক শ্রেণির অভ্যন্তরে স্বার্থের দ্বন্দ্ব, রাজনৈতিক শক্তি, দল ও রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতার কারণে গণতন্ত্র আসে আর যায়।
বিএনপি-র জন্ম সেনা ছাউনিতে। আওয়ামী লীগের জন্ম রাস্তায় ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ ভেঙ্গে। যে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের পুরো সময় ভোটাধিকার ও গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছে, গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের জন্য লড়াই করতে গিয়ে অস্ত্র হাতে দেশ স্বাধীন করতে নেতৃত্ব দিয়েছে– সেই আওয়ামী লীগ এখন মানুষের ভোটাধিকারকে ভয় পায়। মানুষের ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র হরণ করে। যে আওয়ামী লীগ ছিল জনগণ ও লক্ষ লক্ষ কর্মী নির্ভর-সে আওয়ামী লীগ এখন হয়ে পড়েছে ক্যাডার-পুলিশ-আমলা-লুটেরা ব্যবসায়ী নির্ভর। যতই এই দল জনবিচ্ছিন্ন হচ্ছে ততই তার কর্মকাণ্ড হিংস্র হয়ে উঠছে। সংবাদপত্র, বাক, বিচার, ব্যক্তি স্বাধীনতা রুদ্ধ করছে। ছাত্র-জনতার ন্যায়সঙ্গত মিছিলের উপর হামলে পড়ছে। নানা রকমের মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তির সাথে আপস করছে। আমরা দেখি দেশ, দল কোথাও গণতন্ত্রের চর্চা নেই। উত্তরাধিকারের রাজনীতি গণতন্ত্রের চর্চাকে নির্বাসনে পাঠিয়েছে। যা থেকে বিরোধী দলও মুক্ত নয়। ফলে মানুষ রাজনীতিকে দোষছে, রাজনীতির প্রতি অনীহা বাড়ছে। মানুষের ভোটাধিকার প্রয়োগে আগ্রহীনতা-রাজনীতির প্রতি এই অনীহা কার জন্য সুযোগ তৈরি করে? এই বিরাজনীতিকরণ ষড়যন্ত্রকারী অ-সাংবিধানিক শক্তির ক্ষমতা দখল ও আরোহনের পথ কি পরিষ্কার করে না? এই পরিস্থিতি এরশাদ স্বৈরাচারের ক্ষমতা দখলের সময়ও দেশের মানুষ দেখেছে। রাজনীতিবিহীন উন্নয়নের ধ্বজাদারীরাও এটা চাই, এই অবস্থা থেকে তারা উপকৃত হয়।
এরশাদ স্বৈরাচারের পতন হয়েছে ত্রিশ বছর হতে চললো, এর মধ্যে বিএনপি-আওয়ামী লীগ পালাক্রমে ক্ষমতায় এসেছে কিন্তু তাদের অপরাজনীতি ও গণবিরোধী রাজনীতি গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারেনি। গণতন্ত্র ও মানুষের ভোটাধিকার হরণ করে দেশকে করেছে পুলিশী রাষ্ট্র?
এর থেকে বের হওয়ার ও এর থেকে মুক্তির পথ কি? এর জন্য প্রয়োজন জনগণের বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি সমাবেশ। প্রচলিত লুটের’রা ব্যবস্থার বিকল্প কর্মসূচি। প্রয়োজন জনজীবনের অর্থনৈতিক-সামাজিক-সংকট, গণতন্ত্র-ভোটাধিকার, ভাত-কাপড়ের লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে শোষক-লুটেরাদের পক্ষের বিদ্যমান শক্তিভারসাম্য পাল্টিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে অন্দোলনে নামা। গণআন্দোলন-গণজাগরণই পারে ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে।
লেখক: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)