বহু লড়াই-সংগ্রামের রক্তাক্ত পথপরিক্রমায় এসেছিল পরাধীন বাঙালি জাতির স্বাধীনতা। সেই রক্তপথের বীজ রোপিত হয়েছিল ভাষা সংগ্রামের পটভূমিতে। ধর্মভিত্তিক দ্বিজাতি তত্ত্বের শেকল ছিন্ন করে সেদিন মাতৃভাষা রক্ষায় বাংলার মাটি রঞ্জিত হয়েছিল সালাম-বরকত-রফিক-শফিক-জব্বারদের বুজের তাজা রক্তে। রক্তের সেই স্রোত জাতিকে মিলিত করেছিল একাত্তরের সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রামে। এসেছিল ২৬ মার্চ, মহান স্বাধীনতা দিবস।
এবছর বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্ণ করলো। রাষ্ট্র স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছে। জাতির ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ অর্জন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের শ্রেষ্ঠত্ব কেবল ভৌগলিকভাবে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সীমাবদ্ধ ছিল না। সে অর্জনের তাৎপর্য ছিল আরো অনেক গভীর। এ লড়াই ছিল শ্রেণিগত শোষণ ও শ্রেণি বৈষম্যের হাত থেকে মুক্তির জন্য গণমানুষের লড়াই।
মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বে থাকলেও কমিউনিস্ট ও বামপন্থিদের ছিল বিরাট অবদান। মুক্তিযুদ্ধ ছিল বিভিন্ন শ্রেণি-দল ও শক্তির মিলিত সংগ্রাম। এদেশের মানুষের দীর্ঘ গণসংগ্রামের পরিণতি। সমগ্র জাতি ঐক্য, অপরিসীম ত্যাগ ও সংগ্রামের মধ্য দিয়েই মাতৃভূমির স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল।
বাঙালি বীরের জাতি। বাইরের কোনো শক্তি তাকে কখনো বেশিদিন দাবিয়ে রাখতে পারেনি। বিদেশি ও বিজাতীয় আধিপত্যকে সে বারংবার রুখে দাঁড়িয়েছে। বুকের রক্ত ঢেলে সে বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। কিন্তু বাঙালির দুর্ভাগ্য- যে বিজয়কে সে রক্ত দিয়ে ছিনিয়ে আনতে জানে, সেই বিজয়কে সে ধরে রাখতে পারে না। বিজয় লাভ করেও বারবার সে পরাজিত হয়। পরাজিত হয়ে পুনর্বার তাকে নতুন করে বিজয় অর্জন করতে হয়। একাত্তরে আমরা ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ও শ্রেষ্ঠ বিজয় অর্জন করতে পেরেছিলাম। কিন্তু সে বিজয় আমরা ধরে রাখতে পারিনি।
বিজয় আনতে যে দল ও শ্রেণি নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হয়েছিল, তাদের পক্ষে তা রক্ষা করা যে সম্ভব হয়নি বাংলাদেশের ঘটনাবলি সেই অভিজ্ঞতাই তুলে ধরে। বিজয় অর্জন ও একই সাথে তার সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে হলে ভিন্ন ধরনের দল ও শ্রেণির নেতৃত্ব প্রয়োজন। দেশবাসী বিজয় অর্জন করে এবার তা আর হারাতে চায় না। বিজয়কে চিরস্থায়ী করতে চায়। তাই, এবার দেখতে হবে যেন বিজয় অর্জনের পাশাপাশি সে বিজয় ধরে রাখার ব্যবস্থাও নিশ্চিত থাকে। সেজন্য দেশের বামপন্থি শক্তি ও শ্রমজীবী মানুষকে আরো দৃঢ়ভাবে দায়িত্ব নিতে হবে।
১৯৭২ সালের সংবিধানে গৃহীত রাষ্ট্র পরিচালনার চার মূলনীতি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতিটি স্তরে সমভাবে যেন চর্চা ও প্রতিফলিত হয় সেজন্য বিশেষ উদ্যোগ নিতেই হবে।
আমাদের সামনে আজ নতুন করে সেই মহান কর্তব্য উপস্থিত। এবারের সংগ্রামে নেতৃত্ব দিতে হবে মেহনতি মানুষকে। তাদেরকেই মুক্তিযুদ্ধের অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করতে হবে। সকল দেশপ্রেমিক শ্রেণি, স্তর ও ব্যক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে, মেহনতি মানুষের সমস্ত শক্তি ও সমবেত সংগঠিত শক্তিকে নেতৃত্বের ভূমিকা আনতে হবে।