স্মৃতিতে অম্লান কমরেড মণি সিংহ
ডা. অসিত বরণ রায়
কমরেড মণি সিংহ। একটি ইতিহাস এবং একটি রাজনৈতিক পাঠশালা। ১৯৯০ থেকে ২০২০। ৩০ বছর আগে কমরেড মণি সিংহ মৃত্যুবরণ করেছেন। যদিও কোন মহামানবের মৃত্যু হয় না, কারণ তাঁর আদর্শ-কর্ম বেঁচে থাকে যুগের পর যুগ মানুষের হৃদয়ে।
কমরেড মণি সিংহ ছিলেন কিংবদন্তী মহানায়ক-টংক আন্দোলনের নেতা। এদেশের কমুনিস্ট আন্দোলনের বিপ্লবী নেতা। ছোটবেলা থেকেই এই মহামানবের বহু রোমাঞ্চকর কাহিনি শুনেছি। তাঁর চিন্তায়-চেতনায় ধ্যান-জ্ঞান ছিল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের, যিনি প্রতিনিয়তই ভাবতেন বৈষম্যমুক্ত সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ। আমার জীবনে সৌভাগ্য যে কমরেড মণি সিংহের মতো মহামানবের সান্নিধ্য পেয়েছি। প্রায় একযুগ পাশাপাশি কাটিয়েছি। কাছ থেকে দেখেছি আটপৌড়েভাবে। সকাল থেকে রাত-রাত থেকে সকাল যার চুল থেকে নখ পর্যন্ত ছিল বিপ্লবী চেতনায় ভাস্বর।
তিনি ছিলেন একজন কমুনিস্ট এবং পরম পূজনীয় মানবতার পূজারী মহামানব। প্রথম দেখা থেকেই আমি কমরেড মণিসিংহকে দাদু বলে সম্বোধন করি যদিও পার্টির নেতাকর্মীগণ সবাই ‘বড় ভাই’ বলে ডাকতেন। সে সময় কিছুদিন আগেই অণিমাদি (কমরেড মণি সিংহের স্ত্রী) রোড অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছেন। দাদুর সেই শূণ্যতা দাদুকে খুব ব্যাথিত করেছিল। এই সময়েই পার্টি আমাকে তাঁকে দেখাশোনা-সেবাযতেœর দায়িত্ব দেন। আমার মা এবং বাবা যখন শুনলেন এই গুরু দায়িত্বের কথা, তাঁরা আমাকে মসাহস দিয়েছিলেন। বার বার বলে দিয়েছিলেন, কোনভাবেই যেন দাদুর অযত্ন না হয়। দাদু প্রতিটা মুহুর্তই সময় ও নিয়মের মধ্যে থাকতেন। সকালে দাঁড়ি কাটা থেকে শুরু করে দিনের সব কাজই করতেন একদম ঘড়ির কাটার সাথে মিলিয়ে। এর ব্যত্যয় কখনও দেখিনি। সকাল সাড়ে পাঁচটায় ঘুম থেকে ওঠা এবং তারপর সকালের হাঁটা। সেটা শীত হোক-বৃষ্টি হোক-দাদুর ব্যত্যয় ঘটেনি কখনও। বৃষ্টি হলে ছাতা নিয়ে বের হতেন। পার্টি অফিসেও যেতেন সময়মতো। রাত এগারোটায় ঘুম-বাসায় থাকা মানেই তাঁর বই পড়া। সোভিয়েত ইতিহাস গ্রন্থটি দাদু বার বার পড়তেন।
দাদু ভীষণ খেতে পছন্দ করতেন। কোন জিনিস ভালো হলে বেশ তারিফ করতেন। আর খারাপ হলে বলতেন ‘বেশতো’। বিশেষ করে কাঁঠালের ইঁচড় ও ছানার ডালনা এবং চাটনি ছিল তাঁর ভীষণ প্রিয়। ঈদের দিনে আমরা যেতাম আমিনা ভাবীর বাসায়। ভাবী দাদুর পছন্দের রান্নাগুলো করতেন। দাদুর সঙ্গে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক তাঁদের। বিশেষ করে পার্টি যখন নিষিদ্ধ ছিল। ওই সময়ই দাদুদের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক গভীরতর হয়। শান্তি ভাবীও ( কমরেড বারীণ দত্তের স্ত্রী) মাঝেমধ্যে দাদুর পছন্দের খাবার রান্না করে আনতেন।
সবকিছুই ছিল দাদুর সুশৃঙ্খলে বাধা। দাদুর এই সময়নিষ্ঠতা আমাকে ভীষণভাবে আন্দোলিত করতো। তাছাড়া দেখেছি পার্টি কমরেডদের প্রতি দাদুর সহানভূতি। সকলের খোঁজ-খবর নেওয়া ছিল দাদুর নিত্যনৈমিত্তিক কাজ। টংক আন্দোলনে সেদিন যাঁরা ছিলেন,তাঁদের পরিবার বা যারা বেঁচে আছেন, তাঁদের খবর রাখতেন। এরকম একজন ছিলেন ললিত সরকার। আসামে চিকিৎসাধীন ছিলেন-প্রতিনিয়ত চিঠি লিখে দাদু খোঁজ নিতেন। নেত্রকোণার নেতা সুকুমার ভাওয়াল, লতিকা এন মারাক-এরা যখন বাসায় আসতেন-দাদু ভীষণ খুািশ হতেন। তাঁদের নানাবিধ খবর নিতেন। পার্টির কর্মীদৈর উপর ছিল দাদুর পরম দরদ। আমার পার্টির বন্ধুরা যারা ছিল পার্টির কর্মী (আজাদ-বাবু-কামাল), তাঁরা আসলেও দাদু তাঁদের সঙ্গে আলাপ করতেন-খোঁজ নিতেন তাঁদের পরিবারের সকলের।
দাদুর কাছে শুনেছি টংক আন্দোলনের ইতিহাস। পাহাড়ে, জঙ্গলে হাতি ধরার গল্প। তাছাড়া পাহাড়ি আদিবাসী মানুষের জুম চাষের কথা। শীতের রাতে পাহাড়ের আগুন দেখা যেতো। এর মানে জুম চাষের প্রস্তুতি চলছে। তারপর গর্ত খুড়ে নানান ধরণের বীজ পূঁতে দেওয়া হতো-এটাই জুম চাষ। শুনেছি মহাশোলের গল্প। পাহাড়ী মাছ-সোমেশ্বরী নদীতে পাওয়া যেতো। খুবই সুস্বাদু মাছ।
দাদুর কাছে শুনেছি কীভাবে ৭১ সালে জেল ভেঙ্গে বেড়িয়েছিলেন। জেলের সব কয়েদিরা সেদিন দাদুর হুকুমে রাজশাহী জেলের দেওয়াল ভেঙ্গে বের হলেন এবং দাদু স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিয়ে প্রবাসী সরকারের উপদেষ্টা হয়েছিলেন। সময় পেলেই দাদুর কাছে গল্প শুনতাম। শুনেছি ষাট দশকের প্রথম ভাগে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সেই ঐতিহাসিক বৈঠকের কথা। এ বৈঠকের পরেই এদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে পরিবর্তন ঘটতে শুরু করলো। শিক্ষা আন্দোলন, ছয় দফার আন্দোলন, ৬৯-এর গণ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়েই স্বাধীনতা আন্দোলন। দাদু সেদিন বঙ্গবন্ধুকে বুঝিয়েছিলেন, এখনও স্বাধীনতা চাওয়ার সময় আসেনি। দাদুর কাছে শুনেছিলাম বঙ্গবন্ধু সেই কথা,‘দাদা, লিডার ( শহীদ সোহরাওয়ার্দী) বলেছেন আপনার কথা শুনতে। আপনার কথা মেনে নিলাম কিন্তু মনে নিলাম না। আমি বাংলার স্বাধীনতাই চাই।’
মনে পড়ে মালিবাগের বাসায় এসেছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। সেদিন স্বৈরাচারী এরশাদের বিরুদ্ধে কীভাবে আন্দোলন শুরু করা যায় সে বিষয়ে আলোচনা করতে। সেদিনও কমরেড মণি সিং শেখ হাসিনাকে দিক-নির্দেশনা দিয়েছিলেন। আমি সেদিন পাশে বসে দেখেছি এবং শুনেছি সব কথা। সে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন কমরেড মঞ্জুরুল আহসান খান। আমি বার কতক মাননীয় নৈত্রীকে কফি বানিয়ে খাইয়েছিলাম। এই বৈঠকের পরেই গঠিত হয়েছিল ১৫ দল ১৯৮৩ সালের ৩০ জানুয়ারি আব্দুর রশিদ কর্তবাগীশ সাহেবের বাসায়। শুধু ত্ণ্ডাই নয়, পল্টনে ১৫ দলের প্রথম জনসভা কমরেড মণি সিংহের সভাপতিত্বে হয়েছিল। এই হলো কমরেড মণি সিংহ। মৃত্যুর আগে যিনি জেনে গিয়েছিলেন স্বৈরাচারী এরশাদের পতন হয়েছে-জনগণের বিজয় হয়েছে। এই বিজয় ছিল দাদুর কাঙ্খিত।
অসুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত এদেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পুরোধা ছিলেন কমরেড মণি সিংহ। প্রতিটি আন্দোলনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তিনি ভূমিকা রেখেছেন। আজ যখন সাম্প্রদায়িক শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, তখনই কমরেড মণি সিংহকে মনে পড়ে। কারণ, এই অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে তিনি সারাজীবন লড়াই করেছেন। আজকে এই অশুভ শক্তি জাতির পিতার ভাস্কর্য ভাংগছে। এই ভাস্কর্য ভাংগা মানে জাতীয় পতাকাকে অস্বীকার করা-সংবিধানকে অস্বীকার করা-স্বাধীনতাকে অস্বীকার করা।
আজকে যদি কমরেড মণি সিংহ বেঁচে থাকতেন, তবে হয়তো মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী গণতন্ত্রের মানসকন্যা শেখ হাসিনা কমরেড মণি সিংহকে জিজ্ঞেস করতেন,‘কী করবেন?’ হয়তো কমরেড মণি সিংহ বলতেন,‘স্বাধীনতার স্বপক্ষের সকল শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ডাক দেন।’আর এ কারণেই কমরেড মণি সিংহ আজও বাংলাদেশে প্রাসঙ্গিক। কমরেড মণি সিংহকে জানাই লাল সালাম।