মোহাম্মদ শাহ আলম
২৬ মার্চ, ২০২১ আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। দেখতে দেখতে ৫০ বছর চলে গেল। এর মধ্যে কয়েকটি নতুন প্রজন্মের জন্ম হয়েছে। সুবর্ণজয়ন্তী একটি জাতির জন্য উৎসবের আনন্দের দিন। কিন্তু বর্তমান অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক বাস্তবতায় সিংহভাগ মানুষের মধ্যে আনন্দ-উচ্ছ্বাস নেই। তার ওপর মানুষের ওপর নেমে এসেছে বাড়তি বোঝা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সুবর্ণজয়ন্তীর অতিথি হয়ে ঢাকা সফরে এসেছেন। রাজনৈতিক, সামাজিক অঙ্গনে এ নিয়ে শুরু হয়েছে বির্তক। সারাদেশে অঘোষিত রেড এলার্ট ছাড়াও সুবর্ণজয়ন্তীর দিনে দুপুর দু’টা পর্যন্ত জাতীয় স্মৃতিসৌধে সাধারণ মানুষের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখা হয়। কেউ কেউ বলছেন রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কতো থাকবে, একটা দেশের প্রধানমন্ত্রী তো আসতেই পারেন, অন্যরা বলছে হ্যাঁ আসতে পারে, আগেও এসেছে, কিন্তু স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে কেন? মোদী তো ভারতের মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক শক্তির নেতা, গুজরাটের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার নায়ক, আরএসএস’র প্রতিনিধি, বিজেপি’র নেতা। যে সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্ববাদের চেতনা মোদী লালন করেন তা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক। তাই তাঁর আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে অতিথি হওয়া কোনো যুক্তিতেই প্রাসঙ্গিক নয়। জামাতি ইসলামী যুদ্ধাপরাধীর দল, যুদ্ধাপরাধের দায়ে গোলাম আজম ও জামাতের অনেক নেতার ফাঁসি হয়েছে। আরএসএস (রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ) আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, তাহলে সেই দলের নেতা আমাদের স্বাধীনতা দিবসের অতিথি হবেন কেন? এটা আমাদের দেশের জন্য আপমানজনক, জাতির জন্য লজ্জার। সরকারের জনবিচ্ছিন্নতা ও জনগণের ওপর ভরসার অভাবের কারণে এটা হচ্ছে কিনা? ক্ষমতায় থাকার জন্য নজরানা দিচ্ছে কিনা সরকার? মোদীর সুবর্ণজয়ন্তীতে অতিথি হওয়ার বিরোধিতা করা আর অন্ধ ভারত ও হিন্দু বিরোধিতা এক বিষয় নয়। ভারত ও হিন্দু বিরোধিতা যাদের রাজনীতির উপজীব্য তাদের বিষয় আলাদা। ভারতের শোষিত-নিপীড়িত মানুষ এবং প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তি আমাদের বন্ধু, তা আমাদের জানা। তারা ভারতীয় কর্পোরেট পুঁজির শোষণ ও হিন্দু-সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করছে।
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারত, ভারতীয় জনগণ যে সহযোগিতা এবং অবিস্মরণীয় আত্মত্যাগ করেছে তা কোনোদিন ভুলার নয়। ভারতীয় সৈন্যরা মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পাকিস্তানিদের মুখোমুখি যুদ্ধ করেছে আত্মাহুতি দিয়েছে, তা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে। ইতিহাস থেকে তা কেউ মুছে ফেলতে পারবে না। ভারতকন্যা ইন্দিরা গান্ধী ঘরে-বাইরের শত প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতায় যে অকুতোভয় ভূমিকা পালন করেছেন কেউ তা অস্বীকার ও মুছে ফেলতে পারবে কি? পারবে না। বরং বাংলার মানুষ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে ইন্দিরার সেই অসাধারণ ভূমিকার। কিন্তু যে দল গান্ধীকে হত্যা করেছে, আমাদের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে, সেই দল ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় ভারতের ক্ষমতায় থাকলে আমরা সহযোগিতা পেতাম কি? অবশ্যই হয়তো না। সেই দলের নেতাকে কেন আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে অতিথি করতে হবে? এর রহস্য কোথায়, কারণ কী? এরকম হাজারও প্রশ্ন দেশপ্রেমিক মানুষের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।
আমরা যদি ৫০ বছর পেছনে ফিরে যাই তখন ভারতের রাজনৈতিক অবস্থান কী ছিল? ভারত ছিল জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের সদস্য এবং নেতৃত্বদানকারী দেশ, সাম্রাজ্যবাদনির্ভরতামুক্ত স্বাধীন অর্থনীতি গড়ে তোলার উদ্যোগী দেশ। আর পাকিস্তান ছিল সাম্রাজ্যবাদনির্ভর এবং নির্দেশ পালনকারী দেশ। ভারতের রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে ও তার সহযোগিতা আমাদের রাজনীতিকে এবং মুক্তিযুদ্ধকে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ও প্রগতিমুখী করেছে। যুদ্ধের সময় সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে ভারতের ‘মৈত্রী চুক্তি’ আমাদের প্রগতিমুখীনতাকে আরো বর্ধিত করেছে। আজ এই অঞ্চলে রাজনীতির সে পটভূমি ও প্রেক্ষিত নেই। সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছে। সাম্রাজ্যবাদ ও কর্পোরেট পুঁজির প্রতিনিধি, সাম্প্রদায়িক উগ্র মৌলবাদী আরএসএস বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদী ভারতের ক্ষমতার মসনদে। মোদীর নেতৃত্বে উগ্র-সাম্প্রদায়িক শক্তি বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদী কর্পোরেট পুঁজি ও ভারতের কর্পোরেট পুঁজির স্বার্থ রক্ষায় নেমেছে। ভারত আজ বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের মোড়ল আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের সাথে গাঁটছড়া বেঁধেছে। মোদী বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তীতে অতিথি হয়ে এসেছেন বিষয়টি শুধু তা-ই নয়, এসেছেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ও পূর্ব এশিয়ায় ‘আমেরিকা-ভারতের রণনীতি’ বাস্তবায়নের কর্মকৌশল নিয়ে। বাংলাদেশ এখন ভারত-আমেরিকা ও চীনের স্বার্থের রাজনীতির হটবেডে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে চীনের রাষ্ট্রীয় পুঁজির সাথে ভারতীয় কর্পোরেট পুঁজির দ্বন্দ্ব তীব্র। চীনের সাথে আমেরিকান কর্পোরেট পুঁজির দ্বন্দ্বতো রয়েছে, এটা সবার জানা। ভারত-আমেরিকার চীনকে ঘেরাও করার রাজনীতি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভারত-আমেরিকা-জাপান-আস্ট্রেলিয়া জোটবদ্ধ হয়েছে। এই খেলায় বাংলাদেশের অবস্থা কী দাঁড়ায় তা দেখার বিষয়। তবে এই খেলায় ভারত বাংলাদেশকে পাশে পেতে চায়। বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য এটা অশনিসংকেত।
সামনে পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন। মোদী গোপালগঞ্জে মতুয়া সম্প্রদায়ের মন্দিরে এবং সাতক্ষীরার মন্দিরে যাবেন। ১৯৪৭ সালে ভারতের সাম্প্রদায়িক বিভাজন এবং ধর্মপ্রাণ অথচ সামাজিকভাবে অসহায়-নিপীড়িত মতুয়া সম্প্রদায়কে ব্যবহার করতে চায় বিজেপি, কারণ পশ্চিমবঙ্গের ভোটে তারা একটা প্রভাবক শক্তি। পাকিস্তান আমলেও বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকভাবে নির্যাতিত এই সম্প্রদায়কে বিজেপি তাঁর সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কার্ড দিয়ে খেলতে চায়, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে মেরুকরণ ঘটাতে চায়। উদার ও বামশক্তি নির্ভর পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে সংহত করে কর্পোরেট পুঁজির চারণভূমিতে পরিণত করতে চায় পশ্চিমবঙ্গকে বিজেপি। মিয়ানমারের (বার্মা) রাজনীতি অস্থিতিশীল, জনগণের ওপর নিপীড়ন চলছে সামরিক জান্তার। রোহিঙ্গা সমস্যা ভূ-রাজনীতির ফাঁদে পড়েছে। ভারত-আমেরিকা একপক্ষে খেলছে, নিজ দেশে জনপ্রিয় সু চি পশ্চিমা লবির পক্ষে, চীন ও রাশিয়া নিপীড়ক সামরিক জান্তার পক্ষ নিয়েছে, আঞ্চলিক ও গ্লোবাল রাজনীতির কারণে বাংলাদেশ এই দ্বন্দ্বের মধ্যভূমিতে রয়েছে। আঞ্চলিক পরিস্থিতিও উত্তপ্ত। তাই শুধু সুবর্ণজয়ন্তী নয়, বরং মোদী এবার অনেকগুলো কাজ একসঙ্গে নিয়েই বাংলাদেশে এসেছেন। আঞ্চলিক এই পরিস্থিতিতে আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠিত হচ্ছে। পরিস্থিতি কঠিন ও জটিল। বাংলাদেশ সরকার মোদীকে এড়িয়ে যেতে পারতেন, যদি ২০১৪, ২০১৮-এর নির্বাচনে জনগণের ভোটে সরকার নির্বাচত হতো। সরকার জনবিচ্ছিন্ন, রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে আছে বলে মনে হয় না। যদিও ভারত-চীনের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করার চেষ্টা করে চলেছে সরকার।
আগেই উল্লেখ করেছি, এই অঞ্চলের রাজনীতি কঠিন-জটিল ও উত্তপ্ত। এই পটভূমিতে ভারতে কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষ ও বাম গণতান্ত্রিক শক্তি হিন্দুত্ববাদী ও কর্পোরেট পুঁজির স্বার্থ রক্ষাকারী মোদীর বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। অধিকার রক্ষা, আদায়, গণতন্ত্র ও মনবাধিকারের জন্য। লড়াই করছে ধর্মীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে ভারতীয় সমন্বয়বাদকে রক্ষার জন্য। ভারতে জনগণের এই লড়াই আমাদের দেশের প্রগতি ও গণতন্ত্রের লড়াই এক ও অভিন্ন।
পরস্পর নির্ভরশীল এই বিশ্বে বিচ্ছিন্নভাবে প্রগতি ও গণতন্ত্রের লড়াইয়ে জেতা সম্ভব নয়। জিতলেও রক্ষা করা সম্ভব নয়। উপমহাদেশের গণতন্ত্র ও গণবিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থানকে পরাজিত করতে হলে এবং এ অঞ্চলের সম্প্রীতি, সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য উপমহাদেশের জনগণের বন্ধু বাম প্রগতিশীল শক্তির ঐক্যবদ্ধ counter act আজ খুবই প্রয়োজন। একে ভিত্তি করে এর সাথে যোগসূত্র সৃষ্টি করে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক-প্রগতিশীল-গণতান্ত্রিক চেতনার পুনর্জাগরণ ঘটানো সম্ভব।