সিলেট-সুনামগঞ্জকে দুর্গত এলাকা ঘোষণা, পর্যাপ্ত ত্রাণ সরবরাহ ও পুনর্বাসনের দাবি
সিলেট, সুনামগঞ্জসহ সারা দেশের বন্যা পরিস্থিতি, বানভাসি মানুষের দুর্গতি ও সরকারের ভূমিকা বিষয়ে বাম গণতান্ত্রিক জোটের বক্তব্য দেশবাসীর সামনে তুলে ধরতে সাংবাদিক সম্মেলন করেছে বাম নেতৃবৃন্দ।
সাংবাদিক সম্মেলন থেকে অবিলম্বে সিলেট-সুনামগঞ্জকে দুর্গত এলাকা ঘোষণা, পর্যাপ্ত ত্রাণ সরবরাহ ও পুনর্বাসনের দাবি জানানো হয়।
নেতৃবৃন্দ পদ্মা সেতুর আড়ম্বরপূর্ণ উদ্বোধন অনুষ্ঠান স্থগিত করে ওই টাকা বন্যার্তদের ত্রাণ-পুনর্বাসনে ব্যয় করাসহ ৯ দফা দাবি উত্থাপন করেন-
১) সিলেট-সুনামগঞ্জসহ দেশের গুরুতর বন্যা কবলিত জেলাকে দুর্গত এলাকা ঘোষণা কর।
২) বানভাসী সকল মানুষকে সেনা, নৌ, বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টার-বোট দিয়ে দ্রæত নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে আসতে হবে; আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে পর্যাপ্ত খাবার, শিশু খাদ্য, বিশুদ্ধ খাবার পানি, ঔষধ সরবরাহ নিশ্চিত কর।
৩) বন্যার পানি নেমে যাওার সময় থেকে পানিবাহিত রোগ প্রতিরোধের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৪) বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ নিশ্চিত কর। ত্রাণ-পুনর্বাসনে দুর্নীতি-দলীয়করণ বন্ধ কর।
৫) পদ্মা সেতুর আড়ম্বরপূর্ণ উদ্বোধন অনুষ্ঠান স্থগিত করে ওই টাকা বন্যার্তদের ত্রাণ-পুনর্বাসনে ব্যয় কর।
৬) বন্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য সরকারের অপরিকল্পিত উন্নয়ন, বাঁধ-সড়ক নির্মাণ বন্ধ কর। পানি প্রবাহে বাধা সৃষ্টিকারী বাঁধ, রাস্তা অপসারণ কর।
৭) সকল নদী-খাল-জলাশয় ভরাট ও দখল-দূষণ বন্ধ কর; নদী-খাল পরিকল্পিত ও আধুনিক পদ্ধতিতে খনন কর।
৮) পাহাড়-টিলা-বন ধ্বংস বন্ধ কর; প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ রক্ষা কর, জলবায়ু পরিবর্তন রুখে দাঁড়াও।
৯) ভারতের সাথে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী অভিন্ন নদী সমস্যার সমাধান করার উদ্যোগ নিতে হবে।
আজ (২১ জুন), মঙ্গলবার সকাল ১১.৩০টায় পল্টনস্থ ২, মনিসিংহ সড়কের মুক্তি ভবনের ৫ম তলায় সিপিবি কার্যালয়ের মৈত্রী মিলনায়তনে এ সাংবাদিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
সাংবাদিক সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন বাম গণতান্ত্রিক জোটের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক ও বাংলাদেশের ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগের সাধারণ সম্পাদক কমরেড অধ্যাপক আবদুস সাত্তার। বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন সিপিবির সাধারণ সম্পাদক কমরেড রুহীন হোসেন প্রিন্স, বাসদ সাধারণ সম্পাদক কমরেড বজলুর রশীদ ফিরোজ, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সাধারণ সম্পাদক কমরেড মোশরেফা মিশু।
উপস্থিত ছিলেন ওয়ার্কার্স পার্টি (মার্কসাবদী)’র সাধারণ সম্পাদক কমরেড ইকবাল কবীর জাহিদ, বাসদ (মার্কসবাদী) নির্বাহী ফোরামের সমন্বয়ক কমরেড মাসুদ রানা, বাংলাদেশর সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সভাপতি কমরেড আব্দুল আলী।
সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন বাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির সহকারী সাধারণ সম্পাদক কমরেড রাজেকুজ্জামান রতন, সিপিবির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কমরেড অনিরুদ্ধ দাস অঞ্জন, ডা. সাজেদুল হক রুবেল, আনোয়ার হোসেন রেজা, বাসদ (মার্কসবাদী) কেন্দ্রীয় নেতা মানস নন্দী, বাংলাদেশের ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগের সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য শামীম ইমাম, নজরুল ইসলাম, ওয়ার্কার্স পার্টি (মার্কসবাদী)’র বিধান দাস।
বাম নেতৃবৃন্দ বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অতিবৃষ্টি ও ভারত থেকে আসা পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় দেশের প্রায় ১৫ জেলায় ৭৩ উপজেলা প্লাবিত হয়েছে। গত ৫ দিন ধরে সুনামগঞ্জ সারা দেশ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন, সিলেটও প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ পানিবন্দি রয়েছে। ঘর-বাড়ি, ফসল, ধান, চাল, গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগির ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়েছে। হাসপাতাল, বিমানবন্দর, রেল স্টেশন, বাস টার্মিনাল, ব্যাংক ও অধিকাংশ দোকানপাট জলমগ্ন থাকায় যোগাযোগ, চিকিৎসা সেবাসহ সকল সেবা কার্যক্রম বিঘ্নিত হচ্ছে। সিলেট শহর ছাড়া দুই জেলায় কোথাও বিদ্যুৎ নাই, মোবাইল নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন, ইন্টারনেট সেবাও বন্ধ। সুনামগঞ্জ পুরো এবং সিলেট শহরের অধিকাংশ সড়কেই হাঁটুপানি থেকে কোমর পানিতে নিমজ্জিত। আশ্রয় কেন্দ্র অপ্রতুল, খাদ্য, শিশু খাদ্য ও খাবার পানির তীব্র সংকট, সৌচাগার অপর্যাপ্ত। মানুষ ও গবাদিপশুর একসাথে বসবাস এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতি। আজ পানি ধীর গতিতে নামার কথা শুনা গেলেও আশ্রয় কেন্দ্র থেকে এখনও মানুষের ঘরে ফেরা সম্ভব হচ্ছে না। খাবারের জন্য কেন্দ্রগুলোতে মানুষের উৎকণ্ঠা নিয়ে প্রতীক্ষার চিত্র গণমাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে। কিন্তু সরকার প্রশাসন বলছে পর্যাপ্ত ত্রাণ আছে। দুই জেলার ৩০ লাখ মানুষের জন্য ৬০ লাখ টাকা অর্থাৎ ২ টাকা সরকারি বরাদ্দকে বানভাসি মানুষের সাথে প্রহসন বলে নেতৃবৃন্দ উল্লেখ করেন।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, দেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করলো মানুষকে রক্ষায় সরকার, প্রশাসন ও আবহাওয়া দপ্তরের আগাম সতর্কবার্তা প্রেরণ, নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেয়া, দুর্গত মানুষের জন্য খাদ্য, শিশু খাদ্য, পশু খাদ্য, খাবার পানি ইত্যাদি ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে চরম উদাসীন ও ব্যর্থ। মাত্র ২ সপ্তাহ আগেই যেখানে সুনামগঞ্জ ও সিলেটে প্রথমবার বন্যা হয়ে গেল তারপরও সরকার, প্রশাসন ও আবহাওয়া দপ্তরের এহেন দায়িত্বহীনতা ক্ষমার অযোগ্য বলে নেতৃবৃন্দ মনে করেন।
প্রকৃতি ও পরিবেশ ধ্বংস করে রাষ্ট্র-সরকারের অপরিকল্পিত উন্নয়ন, বাঁধ-সড়ক নির্মাণ, পাহাড়-টিলা-বন ধ্বংস করা, নদী-খাল খনন না করা, জলাশয় ভরাট হয়ে যাওয়া এবং নদী-খাল-জলাশয় দখল ও দূষণের কারণেই অতিবৃষ্টি ও বন্যা মহাদুর্যোগ হিসেবে দেখা দিচ্ছে। অন্যদিকে ভারত সরকার মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে কৃত্রিম বনায়ন এবং বাংলাদেশের উজানে অসংখ্য বাঁধ-ড্যাম নির্মাণ করে পানির স্বাভাবিক প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে। ফলে বর্ষায় পানি ছেড়ে দিয়ে বন্যার কবলে ফেলা এবং শুষ্ক মৌসুমে পানি আটকে রেখে মরুভ‚মি বানাচ্ছে যা আন্তর্জাতিক নিয়ম ও আইন বিরোধী। পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় স্রোত কমে গিয়ে বালু জমে নদীর তলদেশ উঁচু হয়ে গেছে, হাওর-বাওর ভরাট হওয়ায় পানির ধারণ ক্ষমতা কমে গেছে। পাহাড়, টিলা কেটে ফেলায় পানি শোষণ করে রাখার ক্ষমতা কমেছে। পরিকল্পিত ও বৈজ্ঞানিক উপায়ে নদী খনন না করায় খনন করে বালু, মাটি দূরে না ফেলে পাড়েই ফেলায় খননকৃত নদী আবার ভরাট হচ্ছে। এসবই হচ্ছে প্রধানত আমাদের সরকারের দুর্নীতি, ভুলনীতি ও লুটপাটের অর্থনৈতিক দর্শনের কারণে।
নেতৃবৃন্দ বলেন, যে কোন দুর্যোগেই একদল মুনাফালোভী ব্যবসায়ী জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে ফায়দা লুটে নেয়। সব থেকে ভয়ংকর হলো প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দুর্যোগে যারা কারসাজি করে দাম বাড়িয়ে মুনাফা করে তা নিয়ন্ত্রণে কোন পদক্ষেপ নেয় না। এবারের বন্যায়ও দেখা গেছে ৮০০ টাকার নৌকা ভাড়া ১০ হাজার টাকা, ১২শ টাকার ২৫ কেজির চিড়ার বস্তা ১৭শ টাকা, ৫ টাকার মোমবাতি ৩০/৪০ টাকা বিক্রি করছে অথচ প্রশাসন নির্লিপ্ত।