শিক্ষা বাজেট কেমন হওয়া উচিত
আকমল হোসেন
কদিন পরেই জুন মাস। প্রতি বছরের মতো এবারও জুনে জাতীয় বাজেট (২০২২/২৩) ঘোষিত হবে, যদিও তার জন্য আরো আগ থেকে কার্যক্রম শুরু হয়েছে। জুনে ঘোষিত বাজেটে এক বছরের আয়-ব্যয় নির্ধারণ হবে। প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর আলোচনা-সমালোচনার পর তা সংশোধিত হবে, তবে সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকায় সরকারি দল যা প্রস্তাব করবে তা-ই অনুমোদন হবে। বিগত একযুগের বেশি সময় ধরে সেটাই হয়ে আসছে।
বিগত বছরের ৩ জুন ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য দেশের ৫০তম এবং বড় অংকের বাজেট ঘোষণা করেছিলেন অর্থমন্ত্রী। ৩, ৮৯, ০০০ কোটি টাকার আয় এবং ৬, ০৩, ৬৮১ কোটি টাকা ব্যয়, ঘাটতি বাজেট ২, ৪১, ৬৮১ কোটি টাকা। বাজেটের আকার জিডিপির ৭.২% এবং প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৮.২%, এবারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিসহ মুদ্রাস্ফীতির কারণে বাজেটে টাকার অংক বাড়বে সেটা অনুমান করা যায়। যার আলামত হিসেবে বংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি টাকার অংক বাড়িয়ে একটি বিকল্প বাজেটের নমুনা ঘোষণা করেছে। বিগত বাজেটে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ ৯৪, ৮৭৫ কোটি টাকা, যা বাজেটের ১৫.৭% এবং শুধু শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বাজেটের ১১.১%। মাথাপিছু বাজেট বরাদ্দ ৩৭, ৩৩৩ টাকা, যা ২০২০/২১ অর্থবছরে ছিলো ৩৬, ১২৬ টাকা। এই যখন অবস্থা তখন আমাদের প্রত্যেকের মাথায় ঋণের বোঝা ৮৫ হাজার টাকা।
বাজেটে মাথাপিছু বরাদ্দ বাড়লেও ব্যক্তি করসীমা আগের মতই রয়েছে। অন্যদিকে করপোরেট কর কমানোর ফলে সুবিধা পেয়েছে ব্যবসায়ীরা। এবারও কালো টাকা তথা অবৈধভাবে আয়ের টাকা সাদা করার সুবিধা রাখায় লাভবান হয়েছে ধনীরা। ফলে মধ্যবিত্তরা সেই অর্থে সুবিধা পায়নি। সরকারি দলের পক্ষ থেকে বাজেটকে যেমন ধন্যবাদ জানানো হয়েছিলো তেমনই বিরোধী দলের পক্ষ থেকে সাধারণ মানুষের স্বার্থের বিপক্ষে বলে মতামত ব্যক্ত করা হয়েছিলো। রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদীর সুখ না দুঃখ প্রবন্ধের কাহিনীর মতো ঘটনা। প্রবন্ধের মূল বিষয় অনুযায়ী সুখবাদীরা সব কিছুতেই সুখ দেখে বা অনুভব করে। অন্যদিকে দুঃখবাদীরা সব কিছুতেই দুঃখ দেখে।
অর্থনীতি ও বাজেট নিয়ে কাজ করা বেসরকারি পর্যায়ের কিছু গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং অর্থনীতিবিদরা বাজেটের নানামুখী সীমাবদ্ধতার কথা বলেছিলেন। তবে সরকার সেটায় তেমন কর্ণপাত করেনি। আমাদের রাজনীতির কালচার এমন হয়ে পড়েছে যে, যে যখন সবকারি দলে থাকে তাদের চেয়ে কোনো জ্ঞাণী ব্যক্তি দেশে আছে বলে তাদের মনে হয় না। সংসদে আলোচনার পর এই বাজেট চূড়ান্ত হওয়ার কথা, সেখানে কিছু রদ-বদল হয়ে আসার একটা সুযোগ থাকলে বিরোধী দল বিহীন সংসদে বাজেট পুনর্বিন্যাসের কোনো সুযোগ ছিলো না।
অতএব অর্থমন্ত্রী সংসদে বাজেট হিসেবে যেটি উত্থাপন করেছিলে সরকারি দলের সংসদ সদস্যরা বিনা বাক্যে সেটিতেই সমর্থন দিয়েছিলেন, এটাই বাস্তব। জনসংখ্যা বৃদ্ধি দেশের প্রবৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি সব মিলে টাকার অঙ্কে বাজেটের কলেবর প্রতিবছর বড় হলেও পূর্বের তুলনায় আনুপাতিক হারে খুব যে বেশি তেমন বলা যাবে না, কারণ ১৯৭২ সালে একজন প্রথম শ্রেণির কর্মচারীর মাসিক বেতন ছিল ৩৭৫ টাকা, সেখানে আজ সেই বেতন ২২, ০০০ টাকা। এক ভরি স্বর্ণের দাম ছিল ৭০ টাকা আর আজ তার দাম ৫০, ০০০ টাকা। ১৯৭৩ সালে ১ জন হাইস্কুল শিক্ষকের বেতন ছিল ১২০ টাকা, ১ জন শ্রমিকের সর্বনিম্ন বেতন ছিল ১৬০ টাকা, তখন ১ মণ চাউলের দাম ছিল ৩০ টাকা, আর বর্তমানে ১ মন চাউলের দাম ২২০০ থেকে ২৫০০ টাকা।
সাড়ে সাত কোটি মানুষের জায়গায় আজ সতেরো কোটি মানুষ, শুধু শিক্ষার্থীর সংখ্যায়ই চার কোটি। সেই দিক থেকে এই বাজেটগুলি একটি প্রবৃদ্ধিমূলক বাজেট, তবে কল্যাণমূলক রাষ্ট্রচিন্তা অথবা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অর্থনৈতিক বৈষম্যহীন আর শোষণমুক্তির জন্য এ বাজেটগুলি ইতিবাচক নয়। করোনা কারণে স্বাস্থ্যখাতে ১০, ০০০ কোটি টাকার অতিরিক্ত বরাদ্দ, সামাজিক নিরাপত্তাখাতে বরাদ্দ কিছুটা বেড়েছে, এই বরাদ্দের মাধ্যমে ১২০টি উপজেলার ৮ লক্ষ নতুন লোককে নতুন করে বয়স্ক ভাতা প্রদানের আওতায় আনা হবে। বন্টন ব্যবস্থায় পরিবর্তন এবং স্বচ্ছতা না আনলে দলীয় করণের কারণে বিগত বছরগুলির মতই অভাবগ্রস্ত লোক না পাওয়ার অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে। স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়নখাতে বিগত বছরের তুলনায় বরাদ্দ না বাড়ায় বিরাট সংখ্যক গ্রাম পুলিশ, আনসার, ভিডিপির চাকুরি স্কেলভুক্তির দাবি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। বহু সংখ্যক নকলনবীশের চাকুরির অস্থায়ীত্ব, ১৪ মাসের বেতন বকেয়া এবং তাদের চাকুরি স্থায়ীকরণের কাজও সম্ভব হবে না।
করোনার কারণে ১৫ মাস ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও অনলাইনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সংসদ টিভির মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম চলমান আছে। তবে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ নিয়ে এবারে বাজেটে তেমন উচ্চ-বাচ্চ্য নেই। দেশের ৪ কোটি শিক্ষার্থী ২০ লক্ষাধিক শিক্ষক-কর্মচারী নিয়ে গঠিত বৃহৎ শিক্ষা পরিবারের জন্য শিক্ষাও প্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ হয়েছে ৯৪, ৮৭৫ কোটি টাকা, যা বাজেটের ১৫.৭%, শুধুই শিক্ষাখাতে বরাদ্দ ১১.১%। অথচ ২০১৫ সালে ওয়ার্ল্ড এডুকেশন ফোরামে গৃহিত এসডিজিস বাস্তবায়নে সরকারের প্রতিশ্রুতি ছিলো দ¦াদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার ব্যয় বহন করবে সরকার। এসডিজি’র ১৭টি লক্ষ্যের মধ্যে ৪র্থ লক্ষ্যে “অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা এবং সবার জন্য জীবনব্যাপী শিক্ষার সুযোগ তৈরি করা।”
৪র্থ লক্ষ্য বাস্তবায়নে ১০টি টার্গেটও নির্ধারণ করা হয়েছে, যা টার্গেটের মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক, উচ্চতর শিক্ষা, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা তরুণ ও প্রাপ্ত বয়স্কদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, জনসাধারণের স্বাক্ষরতা ও গাণিতিক দক্ষতা শারিরীক ও মানসিকভাবে পিছিয়ে থাকা শিশুদের মূলধারায় সম্পৃক্ত করতে একীভূত ও সমতাভিত্তিক শিক্ষা, মানসম্মত শিক্ষা ও মানসম্মত শিক্ষকের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য বাজেটের ২০% এবং জিডিপির ৪% শিক্ষায় বরাদ্দ করবে। ২০২০/২১ বাজেটে শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে বরাদ্দ ছিলো ১৫, ১% তার মধ্যে রুপপুর পারমানবিক বিদ্যূৎ কেন্দের জন্যই বরাদ্দ ছিলো ১৫হাজার ৬৯১ কোটি টাকা, যা শিক্ষাখাতে দেখানো হয়েছিলো। সেই টাকার হরিলুট দেশবাসী দেখেছে। ৭১৪৪ টি একাডেমিক স্বীকৃতি প্রাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৮০, ০০০ শিক্ষক-কর্মচারী এখনও এমপিওভুক্ত হয়নি। এদের ১০/১৫ বছর ধরে বেতনভাতা চালু না হওয়া, অনার্স-মাস্টার্স পর্যায়ের ৫০০০ শিক্ষকের বেতন ভাতা না হওয়া, এই বারের বাজেটে নতুন প্রতিষ্ঠান এমপিও বাবদ ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হলেও অদ্যাবধি কোন নতুন প্রতিষ্ঠান এমপিও করা হয়নি। তবে রমজানের ঈদের পর-পর ২৫০০ নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিও করার কথা সরকার জানিয়েছেন। অবসরে যাওয়া শিক্ষক-কর্মচারীর অবসর সুবিধা ও কল্যাণ ট্রাস্টের ৩/৪ বছরের পাওনা টাকা পরিশোধের জন্য কোন বরাদ্দ নেই। বেসরকারী এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের ১০০০ টাকার বাড়িভাড়া আর ৫০০ টাকার মেডিকেল ভাতা পরিবর্তনের আন্দোলন দীর্ঘ দিনের, এ খাতে কোন কিছু বলা হয়নি।
সরকার কোন ধরনের নীতিমালা ছাড়াই প্রতি উপজেলায় একটি স্কুল ও একটি কলেজ সরকারিকরণ করেছে, এর আওতায় শিক্ষক-কর্মচারীদের পদায়ন ও বেতন-ভাতার জন্য কোন বরাদ্দ রাখেনি, ২০১৬ সালে শুরু করা সরকারিকরণের কাজ চূড়ান্ত হয়নি, প্রতিষ্ঠান হয়েছে সরকারি কিন্তু তার শিক্ষক-কর্মচারীরা এখনও বেসরকারি হিসেবে রয়েছেন।
২০১০ সালে ঘোষিত জাতীয় শিক্ষানীতি সরকার এখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন করতে পারেনি, ১২ বছর আগে শিক্ষার সংকট ও উত্তোরণের পথ হিসেবে অধ্যাপক কবীর চেীধুরী, অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম ও অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চেীধুরী ৯টি কাজ সমাধানের জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছিলেন কিন্তু কাজের কাজ হয়নি। এই সম্মানিত ৫ জন শিক্ষাবিদের মধ্যে ড. সিরাজুল ইসলাম ছাড়া সবাই দুনিয়া থেকে ইতোমধ্যেই বিদায় নিয়েছেন। ২০১৮ সালে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জন্য নতুন জনবল কাঠামো ঘোষণা করার পর সরকারি দল সমর্থিত গৃহপালিত শিক্ষক নেতারা বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা শতভাগ বোনাস পাচ্ছেন এ মর্মে সরকারকে ধন্যবাদ জানান, কিছু কিছু মিডিয়া সেটা প্রচারও করেছিল। কিন্তু বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা শতভাগ বোনাস পাননি।
এবারের বাজেট দিয়েও মুক্তিযুদ্ধের আলোকে অসাম্প্রদায়িক বিজ্ঞানমনস্ক সর্বজনীন ও গুণগত শিক্ষা বাস্তবায়ন সহজ হবে না বলেই মনে হচ্ছে। সর্বজনীন মানবাধিকারের ২৬ ধারা মোতাবেক শিক্ষা জনগণের জন্য মৌলিক অধিকার এবং বাংলাদেশর সংবিধানের ১৫ ধারা মোতাবেক সব মানুষের জন্য অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষাসহ জীবন ধারণের ব্যবস্থা করা রাস্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব, বিষয়টি মাথায় রেখে যে ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন, বিগত সময়ে তার প্রতিফলন ঘটেনি, এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
শিক্ষায় অর্থায়ন, শিক্ষার দর্শন আর শিক্ষা ব্যবস্থাপনা নিয়ে শাসক মহল বিভিন্ন সময়ে আন্তর্জাতিক ফোরামে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তার বাস্তবায়ন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে এ বছরের বাজেটের হিসেব-নিকেশ করলে বাজেটের আঙ্গিকটা পরিবর্তন হওয়ার কথা ছিলো, কিন্তু তা হয়নি।
শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য শিক্ষা প্রশাসনে দক্ষ, যোগ্য এবং অভিজ্ঞ লোকের প্রয়োজন। শিক্ষা কারিকুলামকে যুগোপযোগী করা, বিজ্ঞান ও কারিগরি বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করা, দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষক নিয়োগের জন্য নিয়োগ ব্যবস্থাকে ত্রুটিমুক্ত করা, নিয়োগকৃত জনবলকে প্রয়োজন অনুযায়ী প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা করা, আধুনিক শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ নিশ্চিত করা, এই কাজগুলি করার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংগ্রহ, সংরক্ষণও ব্যবহার নিশ্চিত করা জরুরি। সেইসাথে মহামারি করোণার কারণে শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে শিক্ষায় অতিরিক্ত অর্থের সংস্থান প্রয়োজন তবে পূর্বের বাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দের চিত্র সরকারের পূর্ব প্রতিশ্রুতির সাথে মিল পাওয়া যায়নি, আশাকরি এবারের বাজেটে তেমনটি হবে না।
দারিদ্র্য থেকে উঠে মধ্যম আয়ের দেশ হওয়া সত্ত্বেও শিক্ষায় আমাদের যা বরাদ্দ, তা পার্শ্ববর্তী এবং তৃতীয় বিশ্বের দেশ ভুটান, মালদ্বীপ ও নেপালের চেয়েও অনেক কম। যদিও অন্যখাতের টাকা শিক্ষার মধ্যে দেখিয়ে টাকার অংককে বাড়িয়ে দেখানো হয়। গত বছরের বাজেটে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের ১৭ হাজার ৯৪৬ কোটি টাকা, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের ১ হাজার ৪১৫ কোটি টাকা এবং রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ১৫ হাজার ৬৯১ কোটি টাকা শিক্ষায় দেখিয়ে যেমন শিক্ষাখাতে টাকার অংক বাড়ানো হয়েছিলো এবার ঠিক একই কাজ করা হয়েছে।
গত বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ধর্মীয় সম্প্রীতিও সচেতনতা বৃদ্ধি এবং হাওর এলাকায় জনগণের জীবন মানের উন্নয়ন ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে ইমামদের প্রশিক্ষণের প্রকল্প দেখানো হয়েছিল শিক্ষাখাতে। তবে সেই টাকার সঠিক ব্যবহার হলে কি নাসিরনগর, শাল্লা, ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার মতো মৌলবাদী তাণ্ডব হতো? স্বাধীনতার পরে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ জিডিপির সর্বনিম্ন ১.৮ এবং সর্বোচ্চ ২.৫, আর বাজেটের সর্বোচ্চ ১৪%। যদিও বিভিন্ন সময়ের সরকারগুলি শিক্ষাখাতে জিডিপি ৭% (ইউনেস্কো) ৬% (ডাকার) ৫% (কুদরতই – খুদা শিক্ষা কমিশন) বরাদ্দের সুপারিশ ছিল কিন্তু সেটা না হয়ে ২% বা তার কম এযাবৎ শিক্ষাখাতে বরাদ্দ হয়ে আসছে। বরাদ্দকৃত অর্থেরও একটি অংশ প্রতি বছরই অব্যবহৃত থেকে যায়, একটি অংশ প্রতিরক্ষা খাতের ক্যাডেট শিক্ষায় চলে যায়, আরেকটি অংশ অপচয় হয়ে যায়, প্রকল্পের নামে হরিলুট হয়। ফলে শিক্ষাখাতে যেটি বরাদ্দ হয়, সেটিরও শতভাগ ব্যয় হয়না। বাজেটে টাকার অংকে শিক্ষাখাতে যেটি বরাদ্দ থাকে তারও একটি অংশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিখাতে চলে যায়, আরেকটি অংশ পতিরক্ষা খাতের ক্যাডেট শিক্ষায় চলে যায়।
এমনতর বাস্তবতায় এসডিজি’র ৪নং ধারার “অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা এবং সবার জন্য জীবনব্যাপী শিক্ষার” সুযোগ তৈরি কিভাবে সম্ভব সেটা বোঝা খুবই কঠিন। অন্যদিকে প্রকল্পের নামে বরাদ্দকৃত অর্থের অপচয় শিক্ষার উন্নয়নে আরেকটি অন্তরায়। সরকারের আন্তরিকতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আর মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গিকারের প্রতি দৃঢ় অবস্থানই শিক্ষাক্ষেত্রে শনির দশা কাটতে পারে বলে অনেকেরই বিশ্বাস। বাজেট এখনও চূড়ান্ত হয়নি, ফলে রদবদলের সুযোগ আছে, দরকার শুধু সরকারের আন্তরিকতা। করোনার কারণে শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বাড়তি বরাদ্দ অন্যদিকে নিয়মিত গভর্নিং বডি গঠনের বিপরীতে ৬ মাস পরপর এডহক কমিটির নামে ফিস এরং উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় (স্কুল অ্যান্ড কলেজ) এর একসাথে স্বীকৃতির নীতি বাতিল করে আলাদা আলাদাভাবে অতিরিক্ত টাকা আদায় করা হচ্ছে।
বিশ্বায়নের প্রতিযোগিতায় টিকার জন্য দক্ষ ও যোগ্য জনশক্তি গড়ে তুলতে শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। কারণ বিষয়টি কোন বিশেষ সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর নয়, বিষযটি দেশের সতেরো কোটি মানুষের। জনগণের পাওয়া-না পাওয়ার বিষয়টি সরকারের ওপর নির্ভর করছে, সেইসাথে বিভিন্ন সময়ে সরকার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে শিক্ষাখাতে আর্থায়নের ঘোষণা বা প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছেন সে বিষয়টি বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন। বিষয়টি বিবেচনা করে মাননীয় সংসদ সদস্যরা আগামী বাজেট অধিবেশনে সাধারণ মানুষের স্বার্থে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবেন বলে আশা করি।
লেখক: কলেজ অধ্যক্ষ, সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি।