রাজনীতি-বিরাজনীতি-ছাত্র রাজনীতির গতিমুখ
সুতপা বেদজ্ঞ
ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা সংগ্রাম পর্যন্ত মানুষের অধিকার আদায়ে এদেশের রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের সাথে যুক্ত হয়েছিলো ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষ। এদের মধ্যে সবচেয়ে সোচ্চার অবস্থানে থেকে একাগ্রতার সাথে আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলো ছাত্রসমাজ। সে সময়ের সাধারণ মানুষ ছাত্র সমাজের এই ভূমিকার জন্য তাদের মর্যাদা ও সম্মানের চোখে দেখতো। যারা রাজনীতি করতেন তাদেরও সমাজে বিশেষ মর্যাদা ছিলো।
মানুষের জীবনযাপন, ভালো থাকা বা মন্দ থাকা সবকিছুই নির্ভর করে রাজনীতির ওপর। কারণ রাজনীতি হলো-‘রাষ্ট্রের ব্যাপারে অংশগ্রহণ, রাষ্ট্র পরিচালনা, রাষ্ট্রের ক্রিয়াকলাপের রূপ-লক্ষ্য ও বিষয়বস্তু নির্ধারণ।’ রাজনীতি মানে শুধু মিছিলে স্লোগান দেয়া নয়, রাজনীতি মানে ওমুক নেতা জিন্দাবাদ নয়। আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে ন্যায্য পাওনা বুঝে নেয়া এবং অন্যায় অত্যাচার অন্যায্যতার বিরুদ্ধে কথা বলা, প্রতিবাদে সামিল হওয়াই রাজনীতি। সেদিক থেকে বিচার করলে, দু-একটি বিশেষ সময় বাদ দিলে এ ভুখণ্ডের সাধারণ মানুষকে কখনোই রাজনীতির প্রতি খুব বেশি আকৃষ্ট হতে দেখা যায়নি। কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা, ভাগ্যের ওপর নির্ভরশীলতাকে আকড়েই তারা জীবন অতিবাহিত করেছে এবং এখনও করছে। সাধারণ মানুষ মনে করে রাষ্ট্র-রাজনীতি নিয়ে ভাবনা তাদের কাজ নয়। বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদিতা বা সমাজের গতি-প্রকৃতি সম্পর্কিত ভাবনা-চিন্তায় তারা তখনোই ব্যস্ত হয়ে ওঠেনি। সাধারণ মানুষের সরলতার সুযোগে স্বাধীনতার কিছু পরেই বাংলাদেশে ভিন্ন মত দমনে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল প্রশাসনকে ব্যবহার করে বিরাজনীতিকরণের ধারা শুরু করে।
স্বাধীনতার পর পর দেশে বামপন্থি ও আধা বামপন্থি বুর্জোয়া ধারার প্রভাব প্রায় সমানভাবে লক্ষ্যণীয় ছিলো। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি মাথাচাড়া দেয়নি। বিরাজনীতিকরণের সুযোগে সাধারণ মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে পুঁজি করে ধীরে ধীরে রাজনীতিতে ডানপন্থি ধারা বিস্তার লাভ করতে থাকে। স্বাধীনতার মূল স্তম্ভ সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের চিন্তাকে নির্বাসনে পাঠানো হয়। সংবিধানে রাষ্ট্রকে একটি নির্দিষ্ট ধর্মের মধ্যে আটকে ফেলা হয়। আজ পর্যন্ত এদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয়েছে বা আছে প্রত্যেকেই আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি। এরা কেউই সাধারণ শোষিত বঞ্চিত খেটে খাওয়া মানুষের পক্ষে কাজ করেনি। বরং ধনী ব্যবসায়ীদের এমনভাবে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করেছে যার ফলে দুর্নীতি-লুটপাটের অবাধ রাস্তা খুলে গেছে। ধনী অতি ধনীতে পরিণত হয়েছে। বৈষম্য বেড়েছে। দরিদ্র অতি দরিদ্রের খাতায় নাম লিখিয়েছে। রাজনীতি চলে গেছে ব্যবসায়ীদের হাতে। বুর্জোয়া দলের সংখ্যা বেড়েছে। সাথে সাথে বেড়েছে প্রতিক্রিয়াশীল ডানপন্থি রাজনৈতিক দলের সংখ্যা।
স্বাধীনতার পর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময়কাল বাদ দিলে বড় বুর্জোয়া রাজনৈতিক দল এবং প্রতিক্রিয়াশীল ডানপন্থি রাজনৈতিক দলসমূহের ছাত্র রাজনীতি কখনোই ছাত্রবান্ধব হয়ে ওঠেনি, বরং শিক্ষাঙ্গনের হল দখল, সন্ত্রাস, হত্যা, চাঁদাবাজি, রগকাটাসহ নানা অপরাধে নিজেদের জড়িয়েছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে এদেশে আজ পর্যন্ত যারাই যোগ্য নেতা হয়ে মানুষের মনের মণিকোঠায় স্থান করে নিয়েছেন তাদের প্রত্যেকের ছিলো ছাত্ররাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল অতীত। রাজনীতিতে তখন ন্যূনতম গণতান্ত্রিক চর্চা ছিলো। বর্তমান আওয়ামী লীগের রাজনীতি এবং তাদের ছাত্র রাজনীতি সুস্থধারার ছাত্র রাজনীতির বিকাশকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। এর পেছনে অন্যতম কারণ এই বুর্জোয়া দলের মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চা না থাকা। ভিন্ন মত-পথকে স্পেস না দেয়া। মতামতের স্বাধীনতায় বিশ্বাস না রাখা। ছাত্র সংগঠনকে নিজেদের ক্ষমতা দখল বা ক্ষমতা ধরে রাখার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা। সর্বোপরি বিরাজনীতিকরণের দিকে গোটা ছাত্রসমাজকে ঠেলে দেয়া। তার প্রমাণ আমরা দেখছি বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। যে ছেলেরা বাবা-মা ও কলেজের শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে উচ্চ মাধ্যমিক স্তর শেষ করে রীতিমত ভর্তিযুুদ্ধে অংশ নিয়ে জয়লাভ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পায় সেই ছেলেরা ভর্তির পর কেন-কিভাবে ক্ষমতার রাজনীতির দুষ্টচক্রে জড়িয়ে মাস্তান, চাঁদাবাজ, দখলবাজ বা খুনের সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলছে।
চট্টগ্রাম বিশ্বদ্যিালয় থেকে শুরু করে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের সন্ত্রাসী আচরণের বিষয় বারবার আলোচনায় উঠে আসছে। কিছুদিন পূর্বে ঢাকা কলেজের ছাত্রলীগের ছাত্ররা তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র ব্যবসায়ীদের সাথে যেভাবে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ল এবং দুজন নিরীহ মানুষের প্রাণ গেল এর তো কোনো জবাব দেয়া যায় না। চলতি আলোচনায় রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ড। গত বছরের নভেম্বরে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মো. সেলিমের মৃত্যুতেও ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা কর্তৃক মানসিক নির্যাতনের ফলে তার আকস্মিক মৃত্যু ঘটেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আবরার হত্যায় জড়িত আসামীরাও বুয়েটের ছাত্র ছিল। একসাথে বিশ জন ছাত্রের ফাঁসির রায় দিয়েছেন বিজ্ঞ আদালত। এই যে সম্ভাবনাময় তরুণ-তাজা প্রাণের নির্মম পরিণতি এর জন্য আজকের রাজনৈতিক অসুস্থ চর্চা কি কোনভাবে দায় এড়াতে পারে!
২০১৩ সালের গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন থেকে শুরু করে কোটা বিরোধী আন্দোলন এবং সর্বশেষ নিরাপদ সড়কের দাবিতে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের যে আন্দোলন তা বানচাল করতে পর্যন্ত হেলমেট পরিহিত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা যেভাবে চড়াও হয়েছিলো তা সকলেরই জানা। বিএনপির শাসনামলে তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্রদল কর্তৃক সংঘটিত অপরাধের তালিকা স্মরণ করলে শিউরে উঠতে হয়। এর সাথে যুক্ত হয়েছিলো জামাতে ইসলামের ছাত্র সংগঠন ছাত্র শিবিরের রগকাটা ও চোখ উপরে ফেলার মত নৃশংস নিন্দনীয় ঘটনা।
এদেশে বামপন্থি রাজনীতি শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়াতে না পারার কারণে বামপন্থি ছাত্র সংগঠন শক্তিশালী হতে পারেনি। বামপন্থিরা তাদের বন্ধু চিনতে বারবার ভুল করেছে। পুঁজিবাদী বুর্জোয়া দলগুলোর সাথে নিজেদের জড়িয়ে যতবার আন্দোলন সংগ্রাম করে জনগণের ন্যায্য দাবি আদায় করেছে ততবারই তারা দল হিসেবে প্রতারিত হয়েছে। আন্দোলনের কোনো সুফলই বামপন্থিরা ঘরে তুলতে পারেনি। অনেকেই বামপন্থার কোনো ভবিষ্যত দেখতে না পেয়ে হতাশাগ্রস্ত হয়ে বুর্জোয়া রাজনীতিতে চলে গেছে বা নিষ্ক্রিয় থেকেছে। এই সুযোগে ক্ষমতাসীনেরা নিজেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে বামপন্থি রাজনীতি বিকাশের বিপরীতে দাঁড়িয়ে ডানপন্থি রাজনীতিকে নানাভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে সহযোগিতা করেছে। আর বামপন্থি রাজনীতি যেহেতু মানুষকে অধিকার সচেতন করে তোলে ফলে বুর্জোয়ারা কখনোই এর বিকাশ চাইবে না, এটাই স্বাভাবিক।
১৯৭২ সাল থেকে এদেশে বৈদেশিক সাহায্য আসতে থাকে। প্রতিষ্ঠিত হয় নানা ধরনের এনজিও। কর্মসংস্থানের সুযোগ হয় ঠিকই কিন্তু দুর্যোগ ঘনিয়ে আসে বামপন্থি রাজনীতিতে। জনসচেতনতা নিয়ে যেসব এনজিও কাজ শুরু করে তারা বেছে নেয় বামপন্থি ছাত্র সংগঠনের কর্মীদের। ঐসব কর্মীরা রাজনীতি নয় বরং এনজিও নীতির বুলিবাগিশতায় দেশের মেহনতি মানুষের মুক্তি আবিষ্কার করে। শুরু হয় বামপন্থি রাজনীতিতে বিরাজনীতিকরণের ধারা।
সেই থেকে আজ পর্যন্ত বিরাজনীতিকরণের প্রভাব বামপন্থি ছাত্র সংগঠনের ওপর শেলের কাঁটার মতো বিঁেধ আছে। এখন পর্যন্ত তারা ছাত্রবান্ধব কিছু কর্মসূচির মধ্যে থাকলেও মূলধারার বাম রাজনীতি ও সংগঠনের সাথে যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে আগ্রহ প্রকাশ করছে না। যে সকল প্রাক্তণ এনজিওতে কাজ করছেন বা বিরাজনীতিকরণের ধারার সাথে আছেন তারা তাদের আদর্শে আগামী বাম ছাত্র রাজনীতিকে চালিত করতে চাইছেন। কিন্তু সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য না থাকায় সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের আকর্ষণ করতে তারা ব্যর্থ হচ্ছেন। অনুকরণীয় নেতা-কর্মী গড়ে উঠছে না। মত-পথ এর ভিন্নতায় নিজেদের মধ্যে অবিরত কোন্দলে লিপ্ত থেকে সময় অতিবাহিত করছে। এমনকি বিভক্ত হয়ে দিন দিন ক্ষীণ শক্তিতে পরিণত হচ্ছে।
অন্যদিকে আজকাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের দ্বারা খুন, মারামারি বা কোন উচ্ছংৃখল ঘটনা ঘটলেই ছাত্র রাজনীতি বন্ধের জন্য শিক্ষক, অভিভাবক ও সুধীমহল থেকে দাবি আসতে থাকে। এরাও দেশে বিরাজনীতিকরণের ধারাকেই উৎসাহিত করে। রাজনৈতিক পরিবেশ যদি উন্নত করা না যায় তাহলে ঘরে বসে থাকলেও কারও স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি পর্যন্ত মিলবে না। মনে রাখা দরকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখন মাত্রা ছাড়া দুর্নীতি ও অনিয়ম চলছে। রাজনৈতিক মতাদর্শ ও দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতেই নিয়োগ ও পদোন্নতি অবস্থাকে আরও জটিল করে তুলেছে। গবেষণা ও বিজ্ঞান চর্চা সম্পূর্ণরূপে অবহেলিত। ছাত্র রাজনীতি বন্ধ হলে এসবের সমাধান হবে সে গ্যারান্টি আছে কি?
এদেশের ছাত্র-শিক্ষকেরাই অনেক ক্ষেত্রে আমাদের আশা-ভরসা। সুস্থধারার রাজনীতি বিকাশে তারা তাদের দায়িত্ব পালন করতে কেন পারছে না, তা খতিয়ে না দেখে তাদের ছেঁটে দিলে সমস্যার সমাধান হবে না। উচ্চতর শ্রেণিতে পড়া ছাত্ররা যা করতে পারেনি আমাদের মাধ্যমিকে পড়া ছাত্ররা তা করে দেখিয়েছে। সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামাতে, হাফ পাসের দাবিতে তারা সুশৃঙ্খল গণতান্ত্রিক আন্দোলন করে দেখিয়ে দিয়েছে ছাত্র রাজনীতি কাকে বলে এবং কেন দরকার। আন্দোলন দমাতে যে হেলমেট বাহিনী তাদের ওপর চড়াও হয়েছিলো তারাতো সুস্থ্য ধারার ছাত্র রাজনীতি ধারণ ও চর্চা করে না। তাদের কারণে যখন ছাত্র রাজনীতি বন্ধের কথা বারবার সামনে আনা হয় তখন সমাজে ভুল বার্তা যায়, বিরাজনীতিকেই উৎসাহিত করা হয়। সিভিল সোসাইটির যে অংশ ছাত্র রাজনীতি বন্ধের পরামর্শ দিয়ে বিরাজনীতিকরণের ধারাকে অগ্রসর করতে চায় তাদের ব্যাপারে যথেষ্ট সতর্ক থাকা দরকার।
এখন সময় এসেছে ছাত্র রাজনীতির গতিমুখ সত্যিকার সুস্থ রাজনীতিতে ফেরানোর। আজকের ছাত্রদের ওপরেই তো থাকবে আগামীদিনের রাষ্ট্র পরিচালনার অনেক দায়িত্ব। ছাত্রদের নিজেদের স্বার্থ বুঝতে হবে। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে হবে। সভ্যতাকে এগিয়ে নিতে ছাত্রদের যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানমনস্ক যুগোপযোগী আধুনিক মানুষ হতে হবে। সুস্থ প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতির সাথে তাদের যুক্ত হতে হবে। ছাত্ররাজনীতির নামে বুর্জোয়াদের যে সর্বনাশা খেলা চলছে তার বিরুদ্ধে সব বাম-গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল ও ছাত্রসংগঠনকে ঐক্যবদ্ধভাবে সুস্থধারার ছাত্র রাজনীতির বিকাশে দায়িত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।
লেখক: সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য, খুলনা জেলা কমিটি, সিপিবি।