মুক্তবাজারের নৈরাজ্যে মানুষ দিশেহারা, জিম্মি
মোহাম্মদ শাহ আলম
গত কিছুদিন ধরে ছাত্ররা পরিবহনে হাফ ভাড়া ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করছে। ইতিমধ্যে ঢাকায় দুইজন ছাত্র ও একজন কর্মজীবী মারা গেছে।
২০১৮ সালেও ছাত্ররা নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে নেমেছিল। ৯ দফা দাবি তুলেছিল, সরকার সড়ক আইন করলেও তার জন্য বিধি প্রণয়ণ করতে পারেনি, বাস্তবায়ন করতে পারেনি। এখন শিক্ষার্থীরা ১১ দফা নিয়ে মাঠে আছে।
এদিকে, করোনায় মানুষের জীবন-জীবিকা বিপর্যস্ত। বিভিন্ন গবেষণা রিপোর্টে জানা যায়, করোনার কারণে ৩ কোটি ২৪ লাখের অধিক মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে। দ্রব্যমূল্যের কারণে মানুষের জীবন এমনিতে নাকাল। এ সময় বাড়ানো হলো জ্বালানির দাম। জ্বালানি এমন একটি পণ্য যার প্রভাব-প্রতিক্রিয়া সামগ্রিক। সরকার বিশ্ববাজারে তেলের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে এক লাফে ডিজেল-কেরোসিনের দাম লিটার প্রতি ১৫ টাকা বৃদ্ধি করে। বিশেষজ্ঞদের অভিমত সরকার ছয়মাস তেলের দাম না বাড়াতে পারতো। তেলের দাম যখন কম ছিল তখন সরকার দাম কমায়নি, ৭ বছরে মুনাফা করেছে ৪০ হাজার কোটি টাকা।
তেলের দাম বৃদ্ধির সাথে সাথে পরিবহন মালিকরা-পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধির দাবিতে পরিবহন ধর্মঘট ডেকে বসে। কিন্তু ধর্মঘট ডেকে তারা রাস্তায় না নেমে জনগণকে জিম্মি করে সরকারের সাথে দরকষাকষি করতে থাকে, যদিও জনগণ পরিষ্কার মনে করে- এটা সরকার-মালিক পাতানো খেলা।
সরকার পরিবহন মালিকদের দাবির কাছে নতি স্বীকার করে পরিবহন ভাড়া ২৭ শতাংশ বৃদ্ধি করে। যদিও বাড়তি ভাড়া আদায় করছে ২৭ শতাংশ নয় বরং ৪০ শতাংশ। এখানে নিয়মনীতির কোনো বালাই নেই। অলিখিত হলেও স্বাধীনতার আগে-পরে ছাত্রদের কাছ থেকে হাফ ভাড়া নেয়ার নিয়ম প্রচলিত থাকলেও, তা ভাড়া বৃদ্ধির পর পরিবহন-মালিক শ্রমিকরা নেয়া বন্ধ করে দেয়। ফলে ছাত্রদের সাথে পরিবহন শ্রমিকদের বিরোধ শুরু হয়। সাধারণ গণপরিবহনে যাতায়ত করে মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত মানুষ এবং তাদের সন্তান-সন্ততিরা।
১ ডিসেম্বর পত্রিকার রিপোর্টে প্রকাশ ‘আন্দোলনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা অর্ধেক ভাড়ার (হাফ) দাবি আংশিক পূরণ করতে পেরেছেন। শুধু ঢাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চলাকালে অর্ধেক ভাড়ায় যাতায়াত করতে পারবেন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের চাপে এবং সরকারের আশ্বাসে পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে’ (প্রথম আলো, ১ ডিসেম্বর ২০২১)। অর্ধেক ভাড়ার যে ঘোষণা সেটা রাজধানীর জন্য। সারা দেশের জন্য নয়। এই নিয়ম হলে সারা দেশে নৈরাজ্য বাড়বে।
দেশে দেশে শিক্ষার্থীদের জন্য ভাড়ায় ছাড় রয়েছে। ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, পাকিস্তান, ভূটান, ফিলিপাইনসহ বিভিন্ন দেশে শিক্ষার্থীদের গণপরিবহনের ভাড়ায় ছাড় দেয়া হয়। ভারতের নয়াদিল্লিতে বাস পরিচালিত হয় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান দিল্লি পরিবহন কর্পোরেশনের (ডিটিসি) মাধ্যমে। ডিটিসি ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, শিক্ষার্থীরা নিজেদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচয়পত্র দেখিয়ে বাসের পাস নিতে পারেন। শিক্ষার্থীরা ১০০ থেকে ১৫০ রুপিতে এই পাস নিয়ে এক মাস বাসে চলাচল করতে পারেন। এটি ভারতে প্রায় শহরে চালু রয়েছে। উন্নত বিশ্বেও এই নিয়ম চালু আছে।
আমাদের দেশেও প্রচলিত ছিল স্বাধীনতার আগে ও পরে। কিন্তু প্রচলিত নিয়ম পরিবহন মালিকরা ভঙ্গ করায় শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে নামতে হলো। দাবি আংশিক মানা হলেও পুরোপুরি মানা হয়নি। নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীরা রাজপথে। কারণ রাস্তা-ঘাট-সড়ক মৃত্যুপুরিতে পরিণত হয়েছে।
পরিবহন ব্যবস্থা রাষ্ট্রীয় মালিকানায় না আনলে ভাড়া ও দুর্ঘটনার এই নৈরাজ্য থামবে না। শ্রমিকদের সাথে চুক্তিতে গাড়ি চালালে প্রতিযোগিতায় মানুষের জান যাবে, ভাড়া নিয়ে ছাত্র ও যাত্রীদের সাথে ঝগড়া-বিবাদ লেগে থাকবে। পরিবহন শ্রমিকদের নিয়োগপত্র, বিশ্রাম, কর্মঘণ্টা, বেতন-ভাতা-পেনশন-ছুটি ও কাজের পরিবেশ কিছুই নিশ্চিত হবে না। পুরো পরিবহন সেক্টর এখনই রাষ্ট্রীয় মালিকানায় আনতে না পারলেও বিভাগীয় শহরগুলোতে ট্রান্সপোর্ট করপোরেশন করে সরকারি পরিবহন ব্যবস্থা এখনই চালু করা উচিত।
কিন্তু সরকারের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-নীতি-দর্শন হলো মুক্তবাজারের দর্শন, সরকার কেন ব্যবসা করবে? সরকারের মন্ত্রীরা একথা বলে- সবকিছু বাজার ও প্রতিযোগিতা ঠিক করবে। কিন্তু বাজার ব্যবসায়ীদের স্বার্থরক্ষা করে, মানুষের নয়। এছাড়া এখানে বাজারও নেই আছে সিন্ডিকেট। যাতায়াত পরিবহন, খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা সবকিছুই সিন্ডিকেটের দখলে। রাষ্ট্র-প্রশাসনের সাথে এদের আঁতাত রয়েছে, রাষ্ট্র-প্রসাশনও এদের দখলে। এদের হাত থেকে মানুষ বাঁচতে পারছে না।
মানুষ বাচঁতে চায়, তাই ছাত্র-শ্রমিক-সাধারণ মানুষ অতিষ্ট হয়ে মাঝে মাঝে স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ-বিস্ফোরণে ফেটে পড়ছে। কিন্তু এটা যে শাসকশ্রেণির অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনীতির আদর্শ ও নীতির কারণে ঘটছে মানুষ তা সামগ্রিকভাবে বুঝে উঠতে পারছে না। আবার কে এই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনকে সংগঠিত রূপ দিবে, তাদেরকে পথ দেখাবে, সেই শক্তি ও নেতৃত্ব নেই।
বর্তমানে ষাট-সত্তর-আশি বা নব্বই দশকের ন্যায় সংগঠিত ছাত্র-শ্রমিক রাজনৈতিক আন্দোলন অনুপস্থিত। অন্যদিকে শাসকশ্রেণির দলগুলির মধ্যে ক্ষমতা নিয়ে বিরোধ থাকলেও শাসকশ্রেণি তার অর্থনৈতিক-সামাজিক নীতিতে যে কোনো সময়ের চেয়ে সংহত ও ঐক্যবদ্ধ।
তাই উল্লেখিত সমস্যার মোটামুটি স্থায়ী সমাধান করতে হলে স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন শাসক শ্রেণির যে নগ্নরূপ ও চেহারা উন্মোচিত করছে, এই আন্দোলনকে বিকল্প পথের সন্ধান দিতে হবে। আর তা পারে নীতিনিষ্ঠ প্রকৃত বাম গণতান্ত্রিক শক্তি।
তাই, মানুষের বেঁচে থাকার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা ও মুক্ত বাজারের নৈরাজ্য ও জিম্মি দশা থেকে মানুষকে মুক্ত করার বাস্তব ও জরুরি কাজে হাত দেওয়াই হবে বাম গণতান্ত্রিক শক্তির বিপ্লবী লক্ষ্যে নিত্যদিনের জরুরি কর্তব্য। স্বত্বঃস্ফূর্ত আন্দোলন ব্যবস্থা বদলের আন্দোলনে পরিণত না হলে এই নৈরাজ্য, দুর্ভোগ যাবে না।
লেখক: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি।