বাঁচার মতো মজুরি দাও: রক্তে অর্জিত অধিকার কেড়ে নেওয়া যাবে না
ভাষ্যকার
পহেলা মে এলেই শ্রমিকদের মধ্যে “খুন রাঙা লাল ঝান্ডার” কথা মনে পড়ে যায়। স্মরণে আসে তাদের ৮ ঘণ্টা কাজ-৮ ঘণ্টা ঘুম-৮ ঘণ্টা নিজের অন্যান্য কাজ ও বিনোদনের দাবির কথা। শ্রমিকও যে একজন স্বাভাবিক মানুষ– রোবট বা যন্ত্রের মত শুধু কারখানায় যাওয়া, কাজ করা আর কাজ শেষে খেয়ে-দেয়ে কোনোমতে পরদিন আবার কাজে যাওয়া– এই গবাদিপশুর মত জীবন– এটা যে মানবিক জীবন হতে পারে না সেই কথাটা প্রতিষ্ঠা করার জন্য কী ভীষণ লড়াই-ই না শ্রমিকশ্রেণিকে করতে হয়েছিল পুঁজিবাদের প্রথম যুগে।
পুঁজিবাদের দুর্গ আমেরিকায় শিকাগোর হে মার্কেটে সেই সংগ্রামের সূত্রপাত ঘটেছিল। পরবর্তীকালে সেই সংগ্রামের পথ অনুসরণ করে উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোতে ৮ ঘণ্টার বেশি কাজ করানো বেআইনি ঘোষণা করা হয়েছিল। অতি উন্নত পুঁজিবাদী দেশে যেখানে যন্ত্রই প্রধান প্রধান কাজ করতে সক্ষম, সেখানে শ্রমিকের উৎপাদনশীলতাও অনেক বেশি– সেসব উন্নত পুঁজিবাদী দেশে শ্রমঘণ্টা কমে এসেছে; যদিও শোষণের আপেক্ষিক হার কমেনি। কিন্তু আমাদের মত দেশে ব্যাপারটা ঘটেছে একদম উল্টো। এখানে শ্রমের উৎপাদনশীলতা কম, মালিকের মুনাফাপ্রীতি বা লোভ বেশি, পুঁজি বিনিয়োগ কম– পাচার বেশি। অন্যদিকে বেকার শ্রমিকদের অঢেল সরবরাহ বেড়েই চলেছে– যে কারণে মজুরি আপেক্ষিকভাবে কোথাও কোথাও চরমভাবে এত নিচে নেমে গেছে যে, একজন শ্রমিক একা আর কিছুতেই সংসারের বোঝা টানতে পারছেন না।
আনুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরাই এখানে ৮০ শতাংশ– তাদের অবস্থা আরো খারাপ। সেখানে কোনো নিয়ম কানুন– শ্রমঘণ্টার কোনো বালাইও নেই। শোষণ খুবই নির্মম। এমনকি আনুষ্ঠানিক খাতের শিল্প-কল-কারখানায় কর্মরত স্বামী-স্ত্রী দুজন কাজ না করলে আজ তাদের সংসারে নুন আনতে পানতা ফুড়িয়ে যায়। বাধ্য হয়ে শ্রমিকরা কেউ শহরে থেকে কারখানায় ওভারটাইম করে যে রোজগার করে তা গ্রামের বাড়িতে থাকা পরিবারের কাছে পাঠিয়ে দিতে বাধ্য হয়। কোনো কোনো শ্রমিক কাজের সন্ধানে বাধ্য হয়ে শহরে বা অন্য জায়গায় চলে যান– বিদেশ-বিভূঁইয়ে চলে যান- এবং সেখান থেকে তার রোজগারের উদ্বৃত্ত দিয়ে পরিবারের ভরণ-পোষণ করেন।
পোশাকশিল্পে- ট্যানারিতে বা পুরোনো পাটশিল্পে বর্তমানে বাংলাদেশের যেসব শ্রমিক এখনো কর্মরত তাদের ন্যূনতম মাসিক মজুরি যেটা নির্ধারিত তা এতই অল্প যে তাদের ৮ ঘণ্টা কাজ করলে পোষায় না। মালিকরা তা ভালোই জানেন। তাই শ্রমিকদের তীব্র শোষণ করে কারখানা পর কারখানা তৈরি হয়েছে। কিন্তু শ্রমিকদের প্রকৃত মজুরি খুব একটা বাড়েনি, শ্রমঘণ্টাতো কমেইনি। শ্রমিকদের জন্য আজ পর্যন্ত সরকার একটি স্থায়ী মজুরি বোর্ড নির্ধারণ করতে পারেননি।
কয়েক বছর পর পর অস্থায়ীভাবে বোর্ড নির্ধারণ করে প্রকৃত মজুরি যখনই সরকারিভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে তখনই মালিকরা এর বিরোধিতা করেছেন। ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে স্কপের পক্ষে শ্রমিকদের বর্তমান দাবিটি হচ্ছে জাতীয় সর্বনিম্ন মজুরি হোক মাসিক ২০ (মতভেদে ২৫) হাজার টাকা।
দ্রব্যমূল্য এখন যে মাত্রায় পৌঁছেছে তাতে বেঁচে থাকতে হলে একজন লোকের মাসে কমপক্ষে ১০ হাজার টাকা প্রয়োজন। ৪ জনের শ্রমিক পরিবারের জন্য আসলে দরকার হয় কমপক্ষে ৪ x ১০০০০= ৪০০০০ টাকা। দুজনে চাকরি করলে ন্যূনতম ২০ হাজার টাকা এলে বাড়িভাড়া, শিক্ষা, চিকিৎসা, পরিবহন ও পকেট খরচ হিসাব করলে ৫০০০ টাকা ছাড়া শহরে পুত্র-কন্যাসহ একজন শ্রমিক ঠিকমত বেঁচে থাকতে পারেন না।
তাই এবারের মে দিবসে শ্রমিক শ্রেণিকে সকলের জন্য কাজ এবং ঐ কাজের জন্য জাতীয় ন্যূনতম মজুরি জনপ্রতি ২০-২৫ হাজার টাকার দাবিতে নতুন করে জোট বাঁধতে হবে, সংগ্রামে ঢেউ তুলতে হবে। তবে শুধু টাকায় মজুরি পেলে চলবে না। টাকার ক্রয়ক্ষমতা যেন অক্ষুণ্ন থাকে সেজন্য শ্রমিকশ্রেণিকে এই মে দিবসে আরো কতকগুলো দাবি নিয়ে পাশাপাশি সংগ্রাম করতে হবে। শ্রমিকও একজন মানুষ, শ্রেষ্ঠ মানুষ- তা প্রমাণ করার সময় এসেছে আজ।
তাই আমাদের দাবি- ক) একটি পরিবারের জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণে চাল-ডাল-লবণ-তেল-জ্বালানির নিয়মিত রেশন নিশ্চিত করতে হবে। যাতে বাজারে দাম বাড়ার ফলে মজুরিলব্ধ টাকার ক্রয়ক্ষমতা না কমে যায় সেটা লক্ষ্য রাখতে হবে। অনেক দেশে অবশ্য স্থায়ী মজুরি কমিশন রয়েছে, যারা মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে সঙ্গে বাৎসরিকভাবে টাকায় মজুরির পরিমাণ বাড়িয়ে দেন বা সমহারে মহার্ঘ্য ভাতার ব্যবস্থা করেন। সেটার ব্যবস্থা করার দাবি করতে হবে।
খ) আবাসন- একটি মৌলিক সাংবিধানিক অধিকার। শ্রমিক কলোনি গড়ে তুলে কারখানা ও শিল্প এলাকায় শ্রমিকদের আবাসনের ব্যবস্থা করা দরকার। বর্তমানে যেভাবে বাড়ি ভাড়া দফায় দফায় বাড়িয়ে শ্রমিকদের আয়ের বড় অংশ খাজনাভোগী বাড়ির মালিকরা পকেটস্থ করছেন তা না ঠেকাতে পারলে শুধু মজুরি বাড়িয়ে শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা দেওয়া যাবে না।
গ) শ্রমিকদের সন্তানদের জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা করতে হবে। এটা ছাড়া সমগ্র দেশ উন্নত মানবসম্পদের বা জ্ঞানভিত্তিক উন্নত দেশের পর্যায়ে পৌঁছাতে পারবে না।
প্রশ্ন হচ্ছে, এগুলি কে করবেন- কীভাবে করবেন? মালিকের উদ্বৃত্ত দিয়ে সরকারকে আজ তার ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য প্রয়োজনীয় কর ব্যবস্থার সংশোধন ও বাজেট প্রণয়ন করতে হবে। জনগণের রাষ্ট্র গড়ে তুলতে হবে।
একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকরাই হচ্ছেন সে দেশের মালিক। রাষ্ট্রকে তারা তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী গণতান্ত্রিক ভোটের মাধ্যমে পরিচালিত করবেন। সেটাই নির্ভেজাল গণতন্ত্রের প্রকৃত নিয়ম। রাষ্ট্রকে সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমিক-কৃষকদের মালিকানাধীন রাষ্ট্রে পরিণত করা না গেলে গণতন্ত্রের প্রকৃত দাবি দাওয়া কিছুতেই বাস্তবায়িত হবে না। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রে শ্রমজীবীদের মালিকানা প্রতিষ্ঠার আগে প্রথমে নিজ নিজ এলাকায় কল-কারখানায়, স্কুল-কলেজে মেহনতি মানুষকে ও অন্যান্য শ্রমজীবীদের সুসংগঠিত হতে হবে এবং নিজেদের সাংগঠনিক নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তাই মে দিবসের একটি বড় স্লোগান হচ্ছে “কৃষক-মজুর-ছাত্র-জনতা” ঐক্যবদ্ধ হও। গড়ে তোল “গণ-সক্ষমতা”- প্রতিষ্ঠিত কর “বিপ্লবী গণতন্ত্র”। বর্তমানে আমাদের দেশে ভোটের নামে চলছে টাকা-পেশিশক্তি ও প্রশাসনিক কারসাজির গণতন্ত্র।
এই গণতন্ত্রকে থুতু দিয়ে প্রত্যাখ্যান করে গড়ে তুলতে হবে নিজেদের দ্বারা, নিজেদের জন্য, নিজেদের গণতন্ত্র– সেটা হবে স্বচ্ছ এবং সর্বস্তরের জনগণের কাছে জবাবদিহিমূলক। জনগণ এখানে অধিকার উপভোগ করবেন। প্রশাসকদের এখানে জবাবদিহিমূলক দায়িত্ব পালন করতে হবে।
একই সঙ্গে ধর্মঘট করার অধিকার কোনোভাবেই কেড়ে নেওয়া যাবে না। কেননা সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা করেছেন যে, যে কোনো খাত বা প্রতিষ্ঠানকে তারা জাতীয় সংসদের তরফ থেকে “অত্যাবশ্যকীয় খাত” বা “জননিরাপত্তার” জন্য গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে ঘোষণা করে সেখানে কর্মরত বা চাকরিরত সবার প্রতিবাদ-সংগ্রাম-ধর্মঘটের অধিকার কমপক্ষে ১ বছরের জন্য স্থগিত রাখতে পারবেন। যদিও বলা হয়েছে প্রাথমিকভাবে তা পানি-বিদ্যুৎ-পয়ঃপ্রণালী-ডাক-অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যদ্রব্য-প্রতিরক্ষা খাত ইত্যাদি নির্বাচিত বিশেষ বিশেষ পরিষেবার জন্য কার্যকর হবে। কিন্তু আইনে এমন ধারা রয়েছে যা থেকে বোঝা যায় যে সংসদ চাইলে আইনের মোটা ব্যাখ্যা দিয়ে যে কোনো উৎপাদনশীল কল-কারখানায়-প্রতিষ্ঠানে তা প্রয়োগ করতে পারবেন। শ্রমিকশ্রেণির বহু কষ্টে অর্জিত আইনসঙ্গত ট্রেড ইউনিয়ন, দর-কষাকষির সংগ্রাম ও বৈধ ধর্মঘটের মাধ্যমে সংগ্রাম এগিয়ে নেওয়ার বিশ্বব্যাপী যে স্বীকৃত অধিকার রয়েছে এবং এ যাবৎ বাংলাদেশেও যা কার্যকর ছিল তা এই বিলের দ্বারা রহিত করা হয়েছে। বিলটি জাতীয় সংসদে উত্থাপিত হয়েছে, কিন্তু এখনো পাস হয়নি। এই আইন পাস হলে বর্তমান সরকারের গণতন্ত্রবিরোধী, স্বৈরাচারী মালিকপ্রীতিই আরো প্রবলভাবে প্রমাণিত হবে। যদিও সেটা হয়তো “শৃঙ্খলা” ও “উন্নয়নের” নামেই করা হবে, কিন্তু তা আসলে করা হবে সংসদে যে ৬০ শতাংশের বেশি ধনিক মালিক বর্তমানে সংসদ সদস্য হিসেবে মৌরুসী-পাট্টা গড়ে তুলেছেন তাদেরই পকেট ভারী করার জন্য ও আধিপত্য আরো নিশ্ছিদ্র করার জন্য।
এবারের মে দিবসে তাই শ্রমিকশ্রেণিকেই সবার আগে নিজেদের সংগ্রাম করার হাতিয়ার, ধর্মঘট করার হাতিয়ারকে রক্ষা করার জন্য রুখে দাঁড়াতে হবে।