ডিজিটাল (অ)নিরাপত্তা আইন বাতিল করুন
কাবেরী গায়েন
প্রথম আলো’র গত ২৬ মার্চ ২০২৩ অনলাইন ভার্সনে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনকে কেন্দ্র করে সংঘটিত ঘটনাবলির ধারাবাহিকতায় সারাদেশে ফের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ বাতিলের দাবি জোরালো হয়ে উঠেছে। ঐদিনের পত্রিকায় একটি ফটোকার্ড ব্যবহার করা হয়েছিলো, যেখানে জাকির হোসেন নামের একজন শিশু দিনমজুরের জবানিতে বলা হয়েছে, “পেটে ভাত না জুটলে স্বাধীনতা দিয়া কী করুম। বাজারে গেলে ঘাম ছুটে যায়। আমাগো মাছ, মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা লাগব।”
মূল প্রতিবেদনটি একটি ছবি সহযোগে ছাপা হয়েছে, যেখানে একটি শিশু শহীদ মিনারের গেটের বাইরে থেকে শহীদ মিনারের দিকে তাকিয়ে আছে। শিশুটির নাম এই ছবির সাথে নেই। এবং প্রতিবেদনে দিনমজুর জাকির হোসেন এবং শিশু সবুজ দুজনের বক্তব্যই ছাপা হয়েছে।
পরদিন, ২৭ মার্চ ৭১ টেলিভিশনের সাংবাদিক ফারজানা রুপা এক প্রতিবেদনে জানান, সাভারে গিয়ে সরেজমিনে তদন্ত শেষে জেনেছেন শিশুটির নাম জাকির হোসেন নয়, সবুজ। এবং সাত বছর বয়সী সবুজ স্বাভাবিকভাবেই এমন কথা বলেনি। ৭১ টেলিভিশনের প্রতিবেদনটি প্রকাশের পরে খবরটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে স্বাধীনতা দিবসকে বিতর্কিত করা হয়েছে কি না, এই মর্মে তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়ে যায়। যদিও বিষয়টি ছিলো ফটোকার্ডে একটি নাম ব্যবহারের ভুল, এবং এই ভুল শনাক্ত হবার প্রায় সাথে সাথে প্রথম আলো দুঃখ প্রকাশ করে কার্ডটি প্রত্যাহার করে নিয়েছিলো, সংশোধন করেছিলো মূল প্রতিবেদন। কিন্তু ২৯ মার্চ মশিউর মালেক নামে একজন আইনজীবী প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানকে এক নম্বর আসামি, সাংবাদিক শামসুজ্জামান শামসকে দুই নম্বর আসামি এবং অজ্ঞাতনামা আলোকচিত্রীকে তিন নম্বর আসামি করে রমনা থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫(২)/৩১/৩৫ ধারায় মামলা করেন।
একই অভিযোগে যুবলীগ নেতা সাইদ মো. গোলাম কিবরিয়া তেজগাঁও থানায় আরেকটি মামলা করেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে। ২৯ মার্চ ভোর চারটায় সিআইডি পরিচয়ে ১৫-২০ জন ব্যক্তি সাদা পোশাকে সাংবাদিক শামসুজ্জামানকে তার সাভারের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় এবং সম্পাদক মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। এর পরের ঘটনাবলি সবার জানা। মতিউর রহমান উচ্চ আদালতে ছয় সপ্তাহের আগাম জামিন পেলেও শামসুজ্জামানের জামিনের আবেদন প্রথমবার খারিজ হয়ে যায়, তবে দ্বিতীয়বার আবেদন করে তিনি জামিন পেয়েছেন ৩ এপ্রিল। বিষয়টির আপাত সমাধান হলেও এই আইনের বিলোপ প্রসঙ্গে জনগণ সোচ্চার এখনো।
নির্ভুল তথ্য প্রদান সাংবাদিকতার মৌলনীতি হলেও সাংবাদিকতায় ভুল হওয়া কোনো নতুন বিষয় নয়, এবং ভুল হলে সেই ভুলের সংশোধনী প্রকাশও এক বহুল প্রচলিত চর্চ্চা। প্রথম আলো শুরুতেই ভুল স্বীকার করে সংশোধনী দিয়েছে, ঘটনাটি এখানেই শেষ হতে পারতো। তবুও, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫(২)/৩১/৩৫ ধারায় মামলা দায়ের করা হয়, গ্রেফতার করা হয় সাংবাদিককে। কী আছে এই তিন ধারায়, এবং কেনো আমরা বিরোধিতা করছি?
ধারা ২৫। আক্রমণাত্মক, মিথ্যা বা ভীতি প্রদর্শক, তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশ ইত্যাদি। -(১) যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ডিজিটাল মাধ্যমে।
(ক) ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে, এমন কোনো তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ করেন, যাহা আক্রমণাত্মক বা ভীতি প্রদর্শক অথবা মিথ্যা বলিয়া জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও কোনো ব্যক্তিকে বিরক্ত, অপমান, অপদস্থ বা হেয় প্রতিপন্ন করিবার অভিযোগে কোনো তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশ বা প্রচার করেন, বা
(খ) রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি বা সুনাম ক্ষুণ্ন করিবার, বা বিভ্রান্তি ছড়াইবার, বা তদুদ্দেশ্যে অপপ্রচার বা মিথ্যা বলিয়া জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও, কোনো তথ্য সম্পূর্ণ বা আংশিক বিকৃত আকারে প্রকাশ, বা প্রচার করেন বা করিতে সহায়তা করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ।
বিরোধিতার কারণ
এই ধারা সংবাদমাধ্যমে সব ধরনের অনুসন্ধানী রিপোর্টিংকে সরাসরি নিরুৎসাহিত করে। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি উন্মোচন করে, এমন যেকোনো অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ওই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের জন্য ‘বিরক্তিকর’, ‘বিব্রতকর’ বা ‘অপমানজনক’ হতে পারে। দ্বিতীয় ধারায় ‘বিভ্রান্তি ছড়ানো’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে, তা সুনির্দিষ্ট করা নেই বলে এই ধারা সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের হয়রানি করার হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্রের ‘ভাবমূর্তি ও সুনাম’ ক্ষুণ্ন করা বলতেইবা কী বোঝায়? ব্যাংক খাতে বিভিন্ন ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর দুর্নীতির খবর পরিবেশন বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে দুর্নীতি নিয়ে সংবাদ বা ‘হেফাজতে মৃত্যু’, ‘গুম’ ও ‘বিচারবহির্ভূত হত্যা’ নিয়ে সংবাদকে রাষ্ট্রের ‘ভাবমূর্তি’ ক্ষুণ্ন করেছে আখ্যা দেয়া হচ্ছে, এবং এই আইন এ ধরনের সংবাদ পরিবেশন করায় সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমকে শাস্তি দেওয়ার বৈধতা দেয়।
৩১। আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানো, ইত্যাদির অপরাধ ও দণ্ড।
(১) যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইট বা ডিজিটাল বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন বা করান, যাহা সংশ্লিষ্ট শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে বা অস্থিরতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে অথবা আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটায় বা ঘটিবার উপক্রম হয়, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ।
বিরোধিতার কারণ
সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর ওপর করা কোনো সংবাদ বা সম্ভাব্য শ্রমিক অসন্তোষ, আসন্ন হরতাল বা বিক্ষোভ সমাবেশ নিয়ে পরিবেশিত সংবাদ ‘আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিকারী’ প্রতিবেদন হিসেবে গণ্য হতে পারে। বাংলাদেশে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, এমনকি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তির সংখ্যায় হেরফের হয়। সরকারি পরিসংখ্যানের সঙ্গে সব সময়ই বেসরকারিভাবে সংগৃহীত তথ্যের অমিল থাকে। এ ধরনের ঘটনায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অনুযায়ী ‘গুজব ছড়ানোর’ অভিযোগে সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে।
ধারা ৩৫। যদি কোন ব্যক্তি এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ সংঘটনে সহায়তা করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ এবং অপরাধ সংঘটনে সহায়তা করিবার ক্ষেত্রে, মূল অপরাধটির জন্য যে দণ্ড নির্ধারিত রহিয়াছে, কোনো ব্যক্তি সেই দণ্ডেই দণ্ডিত হইবেন।
বিরোধিতার কারণ
অপরাধ সংঘটনে সাহায্য করার সংজ্ঞায়ন করা হয়নি এবং অপরাধে সাহায্য করার ক্ষেত্রে অভিপ্রায়ের বিষয়টিও নজর দেয়া হয়নি। যেমন, প্রথম আলোর ঘটনায় আলোকচিত্রী সাংবাদিকের নির্দেশনা অনুযায়ী ছবি তুলেছেন, কিন্তু তাকেও অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে। বিচার হলে একই দণ্ডে দণ্ডিত হবেন তিনি সাংবাদিকের সাথে।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, যখনই শাসক শ্রেণি জনগণের আস্থা হারায়, তখনই জনগণের ওপর বল প্রয়োগের মাত্রা বেড়ে যায়। উদ্দেশ্য ভীতির বাতাবরণ তৈরির মধ্য দিয়ে নিরঙ্কুশ ক্ষমতার চর্চা অব্যাহত রাখা। এটা রাজ-রাজড়াদের যুগে যত সরাসরি ছিলো, তথাকথিত গণতন্ত্রের যুগে ততোটা সরাসরি করার মধ্যে সমালোচনা কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে জনরোষের সম্ভাবনা থাকে। তাই বলপ্রয়োগকে বৈধতা দেবার জন্য শাসকশ্রেণি রাষ্ট্রের অন্তত দুটি সংস্থা ব্যবহার করে। একটি আইন সংস্থা এবং অন্যটি গণমাধ্যম। আইনের মোড়কে শাসকশ্রেণির মতাদর্শ মেনে চলার বাধ্যবাধকতা চাপিয়ে দেয় জনগণের ওপর। এই চাপানোটা যখন দৃষ্টিকটু হয়ে ওঠে, তখন গণমাধ্যম একটা আপাত নিরীহ ভাব ধরে সেই মতাদর্শের পক্ষে সম্মতি তৈরি করে। যেমনটি প্রথম আলোর ঘটনায় ৭১ টেলিভিশন এবং অন্যান্য সাংবাদিক-সম্পাদক পরিষদ করেছে। এই জনমত তৈরি এবং আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়াটি অনুধাবণ করলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ বুঝতে সহজ হবে। কেনো আইনটির বিলোপ চাইছি, সেটাও স্পষ্ট হবে।
২০১৮ সালের ৮ অক্টোবর ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ পাস হয়। ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে খসড়া আইনটি জনসমক্ষে আসার পর থেকেই এই আইনের তীব্র সমালোচনা হয়েছে। দেশের সাংবাদিক, সম্পাদক পরিষদ এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলো শুরু থেকেই এই আইনের তীব্র বিরোধিতা করেছে। তাদের সুস্পষ্ট বক্তব্য ছিলো, এই আইন পাস হলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘিত হবে, যা এমনকি তথ্য ও প্রযুক্তি আইন-২০০৬ এর অপপ্রয়োগের চেয়েও বেশি হবে। বিশেষ করে, ১২টি দৈনিকের সম্পাদক একযোগে তিনজন মন্ত্রীর সাথে দেখা করে ছয়টি ধারার বিষয়ে ব্যাখ্যাসহ তাদের উদ্বেগের কথা তুলে ধরেন। মন্ত্রীরা আশ্বাস দিলেও সম্পাদক পরিষদের কোন কথাই মূল আইনে রাখা হয়নি মর্মে হতাশা ব্যক্ত করে সম্পাদক পরিষদ। তারা জানালেন, পূর্ববর্তী আইসিটি অ্যাক্ট-২০০৬ (২০১৩ সালে সংশোধিত)-এর ৫৭ নম্বর ধারা, যে ধারার বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী, সাংস্কৃতিক কর্মীরা প্রতিবাদ জানিয়ে আসছিলেন, সেই ধারাটিকেই ভিন্ন ভিন্ন উপধারায় ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে মাত্র এবং যুক্ত করা হয়েছে অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের মত বাতিল হয়ে যাওয়া পুরনো নিবর্তনমূলক আইন।
২০০৬ সালে আইসিটি অ্যাক্ট (২০১৩ সালে সংশোধিত) প্রণয়ন করা হয়েছিলো উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে বিএনপি সরকার তখন অসাংবিধানিক অবস্থান গ্রহণ করেছে রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজউদ্দিন আহমেদকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হিসেবে নিয়োগ দিয়ে। বিষয়টি সেসময়কার বিরোধীদল আওয়ামী লীগ মেনে নেয়নি। সেই উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে, সরকারবিরোধী সমালোচনা এবং বিরোধী রাজনীতিকে দমন করার উদ্দেশ্যেই এই আইনটি প্রণয়ন করা হয়েছিলো। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে। সেই থেকে বিরোধী মত ও রাজনীতিকে দমন করার জন্য এই আইনের সুবিধা গ্রহণ করে। তবে ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগেই ২০১৩ সালে এই তথ্য ও প্রযুক্তি আইনে সংশোধনী আনা হয়। নজিরবিহীন ভোট কারচুপির মধ্যে আওয়ামী লীগ দ্বিতীয়বারের মত সরকার গঠন করে। এই নির্বাচন দেশে-বিদেশে বিপুলভাবে সমালোচিত হবার প্রেক্ষিতে ২০১৪ সাল থেকে এই আইনের ব্যাপক অপপ্রয়োগ লক্ষিত হয় মূলত বিরোধী রাজনীতি, সাংবাদিকতা এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে বিরোধী মত দমন করার জন্য। হু হু করে বেড়ে যায় এই আইনে মামলার সংখ্যা। এই আইনের ৫৭ ধারার সর্বোচ্চ অপব্যবহারের বিপক্ষে জনমত জোরালো হয়ে উঠলে ২০১৭ সালে ৫৭ ধারা বাতিল করে নতুন আইনের খসড়া প্রনয়ণ করা হয়।
এ জাতীয় আইন তৈরি করাই হয় বিরুদ্ধ মত দমন করার জন্য। ২০১৮ সালের হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৩ সাল থেকে ২০১৮ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত ১৩০০ মামলা দায়ের করা হয়েছিলো পুলিশের পক্ষ থেকে আইসিটি অ্যাক্টের ৫৭ ধারার অধীনে। ৫৭ নম্বর ধারা ছাড়াও, এই আইনের ৫৪, ৫৫, ৫৬ এবং ৬৬ ধারাও ছিলো আপত্তিজনক। দেশব্যাপী রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন, গণমাধ্যম কর্মী এবং সামাজিক মাধ্যমে ক্রমাগত প্রতিবাদের মুখে সরকার ৫৭ ধারাসহ বাকি চারটি ধারা তুলে দিয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ পাস করে।
অভিযোগ রয়েছে যে তথ্য ও প্রযুক্তি আইনের ৫৭ নম্বর ধারাকেই কয়েকটি ধারায় বিভক্ত করে দেয়া হয়েছে মাত্র এই আইনে। এবং অনেক ক্ষেত্রে পূর্বতন আইনের চেয়েও ভয়ংকরভাবে মানবাধিকার লংঘনের নানা কানুন যুক্ত হয়েছে। বিশেষ অভিযোগ ওঠে এই আইনের ২১, ২৫, ২৮, ৩১, ৩২ এবং ৪৩ ধারা নিয়ে। ইতোমধ্যে ২৫, ৩১ এবং ৩৫ ধারা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। দেখা যাক ২১, ২৮, ৩২ এবং ৪৩ ধারায় কী বলা হয়েছে।
ধারা ২১। মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রোপাগান্ডা বা প্রচারণার দণ্ড।
(১) যদি কোনো ব্যক্তি ডিজিটাল মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রোপাগান্ডা বা প্রচারণা চালান বা উহাতে মদদ প্রদান করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ।
বিরোধিতার কারণ
‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ খুবই অস্পষ্ট একটি শব্দবন্ধ। কী কী করলে এই ধারার অধীনে ‘অপরাধ’ বলে গণ্য হবে, তা সুস্পষ্টভাবে নির্দিষ্ট না করায় এবং ‘অপরাধগুলো’কে সংজ্ঞায়িত না করায় এই আইনের গুরুতর অপব্যবহার ও সাংবাদিকদের হয়রানির ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে। কারণ, এর শাস্তি হিসেবে রাখা হয়েছে যাবজ্জীবন পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং/অথবা ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডের বিধান। ফলে এই ধারা শুধু সাংবাদিকদের জন্যই নয়, ইতিহাসবিদ, গবেষক, এমনকি কথাসাহিত্যিকদের মতো সৃজনশীল লেখকদেরও দুর্ভোগের কারণ হতে পারে।
ধারা ২৮। ওয়েবসাইট বা কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করে এমন কোনো তথ্য প্রকাশ, সম্প্রচার, ইত্যাদি। –
(১) যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করিবার বা উসকানি প্রদানের অভিপ্রায়ে ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা প্রচার করেন বা করান, যাহা ধর্মীয় অনুভূতি বা ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর আঘাত করে, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ।
বিরোধিতার কারণ
‘ধর্মীয় মূল্যবোধ’ একটি অস্পষ্ট পরিভাষা। বহির্বিশ্বে ক্যাথলিক ধর্মযাজকদের যৌন হয়রানির অভিযোগ নিয়ে সাম্প্রতিক প্রতিবেদনগুলো প্রকাশ করা সম্ভব হতো না, যদি ওই সব দেশে ধর্মীয় অনুভূতিতে ‘আঘাত’ করে, এমন সংবাদ প্রকাশ রুখতে আইন থাকত। বেআইনি ফতোয়া ও সম্পত্তিতে নারীর অধিকার নিয়ে আলোচনা করাও ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতি ‘আঘাত’ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হতে পারে।
ধারা ৩২। সরকারি গোপনীয়তা ভঙ্গের অপরাধ ও দণ্ড।
(১) যদি কোনো ব্যক্তি ঙভভরপরধষ ঝবপৎবঃং অপঃ, ১৯২৩-এর আওতাভুক্ত কোনো অপরাধ কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ডিজিটাল মাধ্যমে সংঘটন করেন বা করিতে সহায়তা করেন, তাহা হইলে তিনি অনধিক ১৪ (চৌদ্দ) বৎসর কারাদণ্ড, বা অনধিক ২৫ (পঁচিশ) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।
(২) যদি কোনো ব্যক্তি উপধারা (১) এ উল্লেখিত অপরাধ দ্বিতীয়বার বা পুনঃপুনঃ সংঘটন করেন, তাহা হইলে তিনি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে বা অনধিক ১ (এক) কোটি টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।
বিরোধিতার কারণ
অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ঔপনিবেশিক আমলের ব্যাপক নিয়ন্ত্রণমূলক আইন, যা ব্রিটিশ প্রশাসনকে সব ধরনের জবাবদিহি থেকে রক্ষা করার জন্য প্রণয়ন করা হয়েছিল। সরকার যা প্রকাশ করে না, তা-ই ‘সরকারি গোপন তথ্য’ বলে বিবেচিত হতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংক বা সরকারি দপ্তরের অপ্রকাশিত প্রতিবেদন ছাড়া ফারমার্স বা বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বা ব্যাপক অনিয়ম নিয়ে কি কোনো প্রতিবেদন তৈরি করা সম্ভব? প্রতিবেদকের হরহামেশাই মোবাইল ফোনে এ ধরনের দলিলের ছবি তুলতে হয়। তাদের সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া যেতে পারে এই আইনে। এই ধারা বিদ্যমান তথ্য অধিকার আইনেরও পরিপন্থি।
ধারা ৪৩। পরোয়ানা ব্যতিরেকে তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেপ্তার। –
(১) যদি কোনো পুলিশ অফিসারের এইরূপ বিশ্বাস করিবার কারণ থাকে যে কোনো স্থানে এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ সংঘটিত হইয়াছে বা হইতেছে বা হইবার সম্ভাবনা রহিয়াছে বা সাক্ষ্য প্রমাণাদি হারানো, নষ্ট হওয়া, মুছিয়া ফেলা, পরিবর্তন বা অন্য কোনো উপায়ে দুষ্প্রাপ্য হইবার বা করিবার সম্ভাবনা রহিয়াছে, তাহা হইলে তিনি অনুরূপ বিশ্বাসের কারণ লিপিবদ্ধ করিয়া মহাপরিচালকের অনুমোদনক্রমে নিম্নবর্ণিত কার্য সম্পাদন করিতে পারিবেন-
(ক) উক্ত স্থানে প্রবেশ করিয়া তল্লাশি এবং প্রবেশ বাধাপ্রাপ্ত হইলে ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ;
(খ) উক্ত স্থানে তল্লাশিকালে প্রাপ্ত অপরাধ সংঘটনে ব্যবহার্য কম্পিউটার, কম্পিউটার সিস্টেম, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, তথ্য-উপাত্ত বা অন্যান্য সরঞ্জামাদি এবং অপরাধ প্রমাণে সহায়ক কোনো দলিল জব্দকরণ;
(গ) উক্ত স্থানে উপস্থাপিত যে কোনো ব্যক্তির দেহ তল্লাশি;
(ঘ) উক্ত স্থানে উপস্থিত কোনো ব্যক্তি এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ করিয়াছেন বা করিতেছেন বলিয়া সন্দেহ হইলে উক্ত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার।
বিরোধিতার কারণ
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সবচেয়ে বিপজ্জনক বিধান এটি। প্রথমত, আইনটির ২০টি শাস্তিবিধির মধ্যে যখন ১৪টিই জামিন-অযোগ্য, তখন গ্রেপ্তারের ঝুঁকি প্রত্যেক সাংবাদিকের মাথার ওপর ডেমোক্লেসের খড়্গের মতো ঝুলে আছে। এমনকি সাংবাদিকদের ওপর এ আইনের প্রয়োগ না হলেও ভীতির পরিবেশে তাঁরা পেশাগত দায়িত্ব পালনে বাধা অনুভব করছেন। গ্রেপ্তার-আতঙ্ক তাঁদের ‘মানসিক পরিবেশের’ এক প্রাত্যহিক অংশ হয়ে উঠেছে।
এ আইনের আরও বিপজ্জনক দিক হলো, সকল গণমাধ্যমই এখন ডিজিটাল ব্যবস্থায় কাজ করে বলে কম্পিউটার ও সার্ভারসহ কম্পিউটার নেটওয়ার্ক জব্দ করার ক্ষমতা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে দেওয়ার মাধ্যমে কার্যত তাদের যেকোনো সংবাদপত্র, টিভি স্টেশন বা অনলাইন নিউজ পোর্টালের কাজ বন্ধ দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এভাবে কোনো সংবাদপ্রতিষ্ঠান আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ না করেই আইনের এই ধারায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর হাতে সংবাদপত্রের প্রকাশনা বা কোনো টিভি স্টেশনের কার্যক্রম রুদ্ধ করে দেওয়ার শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।
ধারা ৫৩। অপরাধের আমলযোগ্যতা ও জামিনযোগ্যতা।
এই আইনের ১৯টি ধারার ১৪টির ক্ষেত্রেই অপরাধ আমলযোগ্য ও জামিন-অযোগ্য। পুলিশকে নিছক সন্দেহের কারণে এবং পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেপ্তার করার ক্ষমতা দেওয়ায় এবং এতগুলো অপরাধের অভিযোগকে আমলযোগ্য ও জামিন-অযোগ্য করায় আইনটি সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং মানুষের বাক-স্বাধীনতার প্রতি এক বাস্তব হুমকি।
ডিজিটাল অপরাধ দমনে কতোটা সফল হলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন?
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের বছরখানেক পরে ২০২০ সালের মে মাসে সম্পাদক পরিষদ এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা দমনের অস্ত্র হিসেবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ব্যবহারের শঙ্কা ‘এখন গণমাধ্যমের জন্য দুঃস্বপ্নের বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে’। পরিসংখ্যানের দিকে তাকানো যাক।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার হওয়া লেখক মুশতাক আহমেদ কারাগারে মারা গেছেন ২০২১ সালে। এর প্রতিবাদে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার কারণে খুলনায় রুহুল আমিন নামে আরেকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারের পর পুলিশ তাকে রিমান্ডে নিয়েছে। করোনার সময়ে ত্রাণ নিয়ে ফেসবুক পোস্ট দেবার কারণে কারাগারে নেয়া হয়েছে কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর ও ‘রাষ্ট্রচিন্তা’র সদস্য দিদারুল ইসলাম ভূঁইয়াকে। স্বাধীন মতপ্রকাশের জন্য এই আইনে সাংবাদিক, শিক্ষক, লেখক, কার্টুনিস্ট, আলোকচিত্রীসহ অসংখ্য মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সাংবাদিকরা গ্রেপ্তার হয়েছেন পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে ১৯৭টি, যেখানে ৪১টি মামলা হয়েছে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে। ১৯৭টি মামলায় ৪৫৭ ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। ঢাকার সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, ২০১৯ সালে এই আইনে মোট মামলার সংখ্যা ছিল ১১৮৯টি। এর মধ্যে ৭২১টি মামলা থানায় এবং আদালতে ৪৬৮টি। এর মধ্যে বিভিন্ন মামলায় অভিযুক্ত সাংবাদিকের সংখ্যা ছিল ৪৪ জন। একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদের জেরে ওই পত্রিকার সম্পাদকসহ প্রতিবেদকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন সরকারদলীয় এক এমপি। খবরটির লিংক নিজের ফেসবুকে শেয়ার করার কারণে সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলকেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় মামলা দেয়া হয়। প্রায় ৫৩ দিন নিখোঁজ থাকার পর তাকে যশোরের বেনাপোল থেকে আটক দেখায় পুলিশ। পরে সরকারি দলের এমপির দায়ের করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
ব্যক্তিগত পর্যায়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার ক্ষেত্রে বেশিরভাগই হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দেওয়ার কারণে। মামলার অভিযোগগুলো হচ্ছে কটূক্তি, পোস্টের মাধ্যমে মানহানি করা, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির আশঙ্কা এবং ধর্মের অবমাননা। মামলা করেছেন সরকারি দলের এমপি, আমলা, এমনকি সরকারি দলের পরিবহন নেতারাও। যেমন- ২০২০ সালের ২৬ মে করোনা মহামারির কারণে সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটি ও নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে বাস চালানোর বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলে পোস্ট দেওয়ার কারণে দৈনিক মানবজমিনের পলাশবাড়ী (গাইবান্ধা) প্রতিনিধি রফিকুল ইসলাম রতনের বিরুদ্ধে স্থানীয় পরিবহন নেতা আব্দুস সোবহান ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন। পুলিশ মামলার সঙ্গে সঙ্গে রতনকে গ্রেপ্তার করে।
কিন্তু এ আইনে এটিএম বুথ থেকে টাকা চুরি, অনলাইন ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা চুরি, সার্ভার কিংবা ডিভাইস থেকে তথ্য চুরি কোনোটিরই বিচার করা হয়নি। এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জঙ্গি মতপ্রকাশ, নারীর বিরুদ্ধে বিষোদগার, বিজ্ঞানচিন্তা কিংবা অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিরুদ্ধে বক্তব্যের জন্যও এ আইন প্রয়োগের নজির নেই। ফলে নির্দ্বিধায় বলা যায়, আইনটি ডিজিটাল অপরাধ দমনে ব্যর্থ হয়েছে এবং বারবার বিরোধী মত দমনে এবং প্রগতিশীল চিন্তার ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করা হয়েছে। এই আইন বরং সব পর্যায়ের মানুষের বাকস্বাধীনতার বিপরীতে বড় ধরনের অনিরাপত্তা তৈরি করেছে।
অনুগত সমাজ তৈরির কালাকানুন
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটির ব্যবহারের মধ্যেই অপব্যবহার নিহিত রয়েছে। যেমন, ‘ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা’কে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করা পৃথিবীর আর কোনো দেশের আইনে নেই। একই সঙ্গে মতপ্রকাশের অধিকারের বিষয়টি পুলিশকে ব্যাখ্যার অধিকার দেওয়া সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কারণ সংবিধানের ৩৯ ধারায় বাকস্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের যে অধিকার দেওয়া হয়েছে, সে সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেওয়ার অধিকার শুধু উচ্চ আদালতের। সংবিধান এটাও স্পষ্ট করে বলেছে, কোনো আইনেই সংবিধানে দেওয়া মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন করা যাবে না।
তবে সবচেয়ে মারাত্মক ধারা ৪৩, যেখানে পরোয়ানা ব্যতিরেকে তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেপ্তার করার বিধান রাখা হয়েছে। সাংবাদিকদের জন্য এই আইনের অপব্যবহারের সরাসরি উদাহরণ সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের জেল। তৃণমূল পর্যায়ে সাংবাদিকদের কোনো লেখা পছন্দ না হলেই প্রভাবশালীরা সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা করছেন। এসব মামলা-জেল-জুলুমের ভয়ে সাংবাদিক এবং সম্পাদকরা নিজেরাই এক ধরনের সেন্সরশিপ আরোপ করেছেন নিজেদের কাজে। আইনের নিগড়ে বলপূর্বক আনুগত্য আদায়ের কালাকানুনের মধ্যে আটকে গেছে সমাজ। বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের মানুষ যে কোনো বিষয়ে দ্বিমত পোষণে দ্বিধান্বিত হচ্ছেন, গণমাধ্যমে লিখছেন বা বলছেন খুবই সন্ত্রস্ত হয়ে, এমনকি তুলে নিচ্ছেন বলা কথাটিও সামাজিক মাধ্যম থেকে। স্বাধীন বুদ্ধিজীবীতার পরিসর সীমিত হতে হতে অদৃশ্য হতে চলেছে। আর আস্ফালন করে বেড়াচ্ছে নারীবিদ্বেষী, জাতিবিদ্বেষী, পরধর্মবিদ্বেষী বক্তব্য গোটা সামাজিক মাধ্যমজুড়ে। ফলে একদিকে সরকারি নিয়ন্ত্রণ ভয়ংকর হয়ে উঠছে মুক্তবুদ্ধি চর্চ্চাকারীর ওপরে, অন্যদিকে ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর আস্ফালনে কোথাও বা চুল কেটে নেয়া হচ্ছে বাউল শিল্পীদের, পরিকল্পিতভাবে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের প্রতি বিদ্বেষ ছড়িয়েও চিহ্নিত মহল বিচারের বাইরে থেকে যাচ্ছে। ফৌজদারি মামলায় পড়ার কথা যে অপরাধের, সেগুলো মীমাংসিত হচ্ছে রাজনৈতিক বিবেচনায়।
স্বাধীন মতপ্রকাশের দায়ে যারাই জেলে যাচ্ছেন, ফিরে আসার পরে তারা নীরব হয়ে যাচ্ছেন। এই আনুগত্য নির্মাণকারী আইন যতদিন থাকবে, ততদিন সীমিত সাংবাদিকতা এবং খণ্ডিত বাকস্বাধীনতার দেশেই বাস করতে হবে। দুঃখজনক হলো, দেশের অন্যান্য পেশাজীবী সংগঠনের মত সাংবাদিক সংগঠনগুলোও রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত। ফলে পেশাগত কোনো কার্যকরী উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। তাই দায়িত্ব বেড়ে গেছে প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলোর।
এই অন্যায়ের প্রতিবাদ জারি রাখা এবং সারাদেশে এই আইনের ভয়াবহতা সম্পর্কে জনমত তৈরি করা এখন অন্যতম রাজনৈতিক দায়িত্ব। ধরিয়ে দিতে হবে জনসাধারণকে কীভাবে তথ্যপ্রযুক্তির নিপীড়নমূলক ৫৭ ধারায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন হয়ে একটি অনুগত সমাজ তৈরির জন্য কাজ করে যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে যে স্বাধীন বাংলাদেশ নির্মিত হয়েছিলো সেই স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক যেন সরকারের অনুগত প্রজায় রূপান্তরিত হতে বাধ্য না হয়ে যায়, সেটি দেখা বুদ্ধিজীবীদের দায়, দায় আছে সাংস্কৃতিক কর্মীদের। সবচেয়ে বেশি দায় প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের। ডিজিটাল (অ)নিরাপত্তা আইন বাতিল হতেই হবে।
লেখক: শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।