কৃষকের আত্মহত্যা
নূরুননবী শান্ত
মরে যাবার আগে কথা বলার শক্তি রবি মারান্ডি প্রায় হারিয়ে ফেলেছিলেন। গণমাধ্যমে জানা যায় যে, একটি কথাই তিনি বলতে পেরেছিলেন, “দুঃখ লেগেছিল”। অভিনাথ মারান্ডিও মরে যাবার আগে পরিবারের সদস্যদের কাছে বলেছেন যে তিনি সেচের পানি না পেয়ে বিষপান করেন (ডেইলি স্টার, ২৮ মার্চ)।
সেচের পানি না পাওয়ার দুঃখে অভিমানে অপমানে আত্মহত্যার উদ্দেশ্যে বিষপান করলেন বরেন্দ্রভূমির গোদাগাড়ীর এই দুই কৃষক। ২৩ মার্চ বুধবার। বিশ্ব পানি দিবসের পরের দিন। যখন বরেন্দ্রের অবিকল্প জীবন ভূগর্ভস্থ পানির অপরিনামদর্শি ব্যবহারের পরিনাম নিয়ে কথা হচ্ছে। অনেক দিন ধরেই কথা হচ্ছে। পানির সুষম বণ্টন এ অঞ্চলের পানি ব্যবস্থাপনার সবচেয়ে স্পর্শকাতর কার্যক্রম হবার কথা। সহমর্মিতার সাথে কৃষকদের সেচের পানিসেবা প্রদান করার কথা। কিন্তু পানিবঞ্চনায় একজন কৃষক মরে পানি দিবসের পরের দিন, আরেকজন স্বাধীনতা দিবসের আগের দিন। স্পষ্টতই এই মৃত্যু বিএমডিএর অপেশাদার নিষ্ঠুর অরাজক ব্যবস্থাপনার নমুনা হয়ে থাকলো।
গোদাগাড়ী উপজেলার ঈশ্বরীপুরের অভিনাথ মারান্ডি অন্যের ২৫ কাঠা জমি বর্গা নিয়ে চাষ করতেন। রবি মারান্ডি বোরো আবাদ করেছিলেন নিজের এক টুকরো জমিতে। এই তাদের একমাত্র সম্বল। আবাদের পরের মৌসুম না আসা পর্যন্ত তাদের জীবিকার একমাত্র আশা। এখন বোরোধানের খেতে পানি না দিলে চারা নষ্ট হবে। ধান পুষ্ট হবে না। চিটা তৈরি হবে। আবাদের কিছুই থাকবে না। জমি তৈরি করা, সার-বীজের পেছনে এক কাড়ি টাকা খরচ করা, গায়ের রক্ত পানি করে প্রায় মাস তিনেক হাড়ভাঙা পরিশ্রম করা– সব বিফলে যাবে। আশার মৃত্যু ঘটবে।
গোদাগাড়ীর ঈশ্বরীপুরের ২ নম্বর বরেন্দ্র গভীর নলকূপ থেকে এদের জমিতে সেচের পানি যাবার কথা। কিন্তু সময়মতো যায়নি। বরেন্দ্র বহুমুখি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) নলকূপ চালানো ও পানি বিতরণের দায়িত্ব অর্পণ করেছে সাখাওয়াত হোসেনের ওপর। একইসঙ্গে যিনি কৃষক লীগের স্থানীয় ওয়ার্ড কমিটির সভাপতি। তার নামে স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির অভিযোগ আছে বলে জানা যায়। তবু সেবামূলক প্রতিষ্ঠানকে দলীয়করণ করার শক্তিতে সাখাওয়াত হোসেনই ঠিক করেন যে কার খেতে কখন কয়বার পানি দিতে হবে। কার খেত শুকিয়ে আশার মৃত্যু হলো “কিবা তাতে আসে গেল”! সাখাওয়াতের পেছনে ১২ দিন ধরনা দিয়েও বোরো খেতের জন্য পানি পাচ্ছিলেন না অভিনাথ। তার চাচাত ভাই রবিও পাচ্ছিলেন না। ওদের অসহায় পানিবঞ্চনা ঈশ্বরীপুরের সবাই দেখেছে। খেত শুকিয়ে যাচ্ছিল। শুকিয়ে যাচ্ছিল অভিনাথ-রবিদের বুকের ভেতরটা। দয়া তো চাননি, ফসলের জন্য পানি চেয়েছিলেন। সাখাওয়াতকে তারা অনুনয়-বিনয় করে বলেছিলেন যে ফসল না হলে তাদের এমনিতেই না খেয়ে মরতে হবে, তাই পানি না পেলে তারা আত্মহত্যা করবেন। সাখাওয়াত তাদের কথায় গুরুত্ব দেননি। বোঝারও চেষ্টা করেননি যে এক মৌসুমের ফসল না পেলে গরিব নিরুপায় সাঁওতাল পরিবারগুলোর পরের মৌসুম অন্ধকার হয়ে যায়, ভবিষ্যৎ বলে কিছু থাকে না। সাখাওয়াত তাদের বিপন্নতার জন্য দুঃখও প্রকাশ করেননি। উল্টো, প্ররোচিত করেছেন আত্মহত্যা করতে। গালি দিয়ে সাখাওয়াত বলেছেন, “বিষ খা গা!” অভিনাথ ও রবির জন্য পরম দুঃখের ব্যাপার। আমাদেরও দুঃখ লেগেছে। পানি না পেলেও এ দেশের নাগরিক হিসেবে ভালো ব্যবহার পেতে পারতেন অন্তত। অথচ তাদের বঞ্চনার ঘায়ের ওপর গালাগালির চাবুক মারা হয়েছে। ওঁরা দুর্বল নাগরিক। তদুপরি সংখ্যালঘু। বঞ্চনার ইতিহাসে ভরা স্বভাবত প্রকৃতি-নির্ভর জঙ্গল-নির্ভর জনগোষ্ঠির পিছিয়ে পড়া মানুষ। সামান্য সদাচারণ ও সম্মানের জীবন ছাড়া আর কিছু চান নাই। ধারাবাহিক কাঠামোগত ও সামাজিক উপেক্ষা ওদের এতটাই বিপর্যস্ত করে তুলেছে যে মরে যাওয়াই কর্তব্য মনে হয়েছে। প্রতিবাদের চরম পথ অবলম্বন করা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারেননি।
অভিনাথের স্ত্রী রোজিনা মারান্ডি আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার বিরুদ্ধে মামলা করলেও পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা এলাকা সফরের পরও এসপি মাসুদ মন্তব্য করেছেন যে, “পুলিশ এখনো বিশ্বাস করতে চায় না যে শুধুমাত্র সেচের পানির অভাবে একজন কৃষক আত্মহত্যা করতে পারেন।” এভাবে অভিযুক্ত সাখাওয়াতকে আত্মগোপনে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। অনুমান করা যায়, সাখাওয়াত দীর্ঘদিন পলাতক থাকবেন। ততদিনে সর্বস্বান্ত রোজিনা মামলা চালানোর সক্ষমতা সম্পূর্ণ হারাবেন, মামলা তুলে নেবেন অথবা অধিকতর বিপদ এড়াতে বসতভিটা ত্যাগ করবেন। এরকম উদাহরণ রাজশাহী, নওগাঁ, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁওয়ে কম নেই। ফজলে হোসেন বাদশা এমপি বিস্ময় প্রকাশ করেছেন, “এটা আশ্চর্যজনক যে এত চাক্ষুষ প্রমাণ থাকতেও কেন পুলিশ অভিযুক্তকে গ্রেফতার করতে বিলম্ব করলো”।
আমাদের প্রশ্ন, অপরাধ না করে থাকলে সাখাওয়াত কেনইবা পালালেন! নাকি আমাদের ঘুনে ধরা ব্যবস্থার মধ্যে ক্ষমতাহীন নাগরিকদের ওপর অবহেলা ও অবিচার করার বন্দোবস্ত আছে? অপরাধী পালিয়ে বাঁচবেন, আর অপরাধের শিকার হয় মরবেন নয় মানবাধিকারবঞ্চিত কীটের জীবনযাপন করবেন। তা না হলে নিরাশার অন্ধকারে পতিত দুজন কৃষকের মৃত্যুর ভয়াবহতার প্রতি সামান্য সহানুভূতি প্রকাশ না করে বিএমডিএর অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আগ বাড়িয়ে বলবেন কেন যে, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়! কাঠামোবদ্ধ অপরাধের নিরীহ শিকারের ওপর দোষারোপ করার প্রবণতা ধ্বংসাত্মক। আমরা তা বারবার দেখতে পাচ্ছি। তদন্ত ছাড়াই মনগড়া বিশ্বাসতাড়িত মন্তব্য করে ভুক্তভোগীদের জঘন্যভাবে অপমান করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ওপর যখন তাদের পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নির্ভর করে, তখন সমাজ থেকেও বিশ্বাস উঠে যায়। নিজের ওপরেও বিশ্বাস উঠে যায় সম্ভবত। যখন মানুষ দেখে যে অসহায় বলেই তাকে প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করে গালাগালি করা যয় এবং তার কোনো প্রতিকার থাকে না, ক্ষমতাহীন মানুষ তখন আশা সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলে। জীবনের কাছে পরাজিত বোধ করে। সন্তানদের খাবারের নিশ্চয়তা বিধান না করতে পারার অপমান ও মর্যাহীনতার বোধে আক্রান্ত হয়। হয়ে উঠতে পারে আত্মহত্যাপ্রবণ। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর গরিব মানুষদের প্রতি এমন উপেক্ষা বরেন্দ্রে নতুন ঘটনা নয়। আলফ্রেড সরেন হত্যাকাণ্ড, গোবিন্দগঞ্জের হত্যাকাণ্ড আরও কতকিছুই তো সন্ত্রস্ত করে রেখেছে সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষদের মনোজগত বছরের পর বছর। পানি নিয়ে তাদের মারামারি করতে হয়, সেটাও হয়ে ওঠে তাদেরই স্বভাবদোষ! পানি সরবরাহের অব্যবস্থাপনা নিয়ে একটি কথাও কেউ বলবে না! এইসব চলমান অবহেলা, দায়িত্বহীনতা, দুর্নীতি, দোষারোপ, বিচারহীনতার ধারাবাহিক ভয় ও বিপন্নতা দেখতে দেখতে অভিনাথ-রবি বিষপান করে মরে যায়।
মরে যাবার পরে তড়িঘড়ি করে তাদের জমিতে হয়তো পানি দেওয়া হয়, সাথে চলে অপরাধের শিকার ব্যক্তিদের প্রতি দোষারোপ। চলে ঘটনার মোড় ঘুরিয়ে দেবার বিবিধ ফন্দি ফিকির। ফলে সুস্পষ্ট অপরাধ ঢাকতে তদন্তের আগেই বিশ্বাস দিয়ে ঘটনার বিচার করা চলতে থাকে। পুলিশ কিংবা দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান কী করে উপলব্ধি করবেন অভিনাথ-রবির বেদনা কতোটা গভীর! ভাত খাবার জন্য প্রকৌশলী ও পুলিশদের তো জমিতে নামতে হয় না। আধিয়ার কৃষকের এক মৌসুমের ক্ষতি তার সামান্য ভাতের স্বপ্নকে কিভাবে হত্যা করে তা বোঝার মন মরে গেছে এই রাষ্ট্রের সর্বস্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের। তারা বরেন্দ্রের কৃষকদের পানি নিয়ে জীবন বাজি রাখতে দেখলে তাই অবিশ্বাস করে। খুঁজতে থাকে আত্মহত্যার সেইসব কারণ যেগুলো তাদেওর দায়মুক্তির সুখ দেবে। তাদের বিশ্বাস কেবল নিজেদের সুখের নিশ্চয়তার ওপর। বরেন্দ্র অঞ্চলের সাঁওতাল, ওঁরাওসহ নানা জাতি-গোষ্ঠীর মানুষেরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সংকটজনক পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে পারেন না। তাদের জীবন থেকে জঙ্গল তো হারিয়েছে বহু আগে। এখন তাদের জমি হারিয়ে দিনমজুরে পরিণত হবার যুগ চলছে। এমনকি আধিয়ার হয়েও আর নিস্তার নেই। সেচের জন্য পানি পেতে কর্তৃপক্ষকে তুষ্ট করতে পারতে হবে। সে ক্ষমতা না থাকলে ‘বিষ খা গা’। অন্যদিকে, শোনা যায়, বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের গভীর নলকূপের অপারেটররা অনেকেই নিরুপায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কৃষকদের জমির ক্রেতা হয়ে উঠেছেন। তার জন্য খুব সহজ পদ্ধতির ভেতর দিতে যেতে হয়। গরিব কৃষককে প্রথমে হয়রানি করতে থাকো, তারপর তাকে কায়দা করে শোষণ করো। এই দুর্বৃত্তায়নের বেড়া ডিঙানোর কোনো পথই আর খোলা ছিল না গোদাগাড়রি দুই ভাইয়ের সামনে। মনের দুঃখের ভার অবহনযোগ্য হয়ে উঠেছিল তাদের কাছে। তারা বিষ খেয়ে মরে গেছেন। বিষ খেয়েছেন সাখাওয়াতের সামনেই।
সাখাওয়াত তাদের বাঁচানোর চেষ্টাও করেনি। মরণাপন্ন অভিনাথকে ফেলে দিয়ে আসা হয় তার বাড়ির সামনে। রবিকে শেষ পর্যন্ত হাসপাতালে নিলেও অনেক দেরি হয়ে যায়। কাউকেই আর ফেরানো যায় না জীবনে। অভিনাথ-রবিদের পূর্ব-পুরুষরাই তো তেভাগা আন্দোলনে প্রাণ দিয়েছিল, মুক্তিযুদ্ধের সময় তীর-ধনুক নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। আর আজ, পঞ্চাশ বছর বয়সী স্বাধীন বাংলাদেশে, প্রত্যেক নাগরিকের সমান অধিকারের বাংলাদেশে, ৩৬ বছর বয়সের তরুণ সাঁওতাল অভিনাথ মারান্ডি, ২৭ বছর বয়সী যুবক কৃষক রবি মারান্ডি আত্মহত্যা করছেন। এর দায় কি আমরা এড়াতে পারি? গরিব মানুষ বেশিকিছু চায় না। নিতান্ত খেয়ে বাঁচতে চায়। সবাই সুখে না থাকুক, অন্তত বৈষম্যের অপমান অবহেলার গ্লানি থেকে মুক্ত থাকুক, এটুকুই চায়। কাউকে কাউকে গায়ের জোরে পেছনে ঠেলে দেওয়ার উন্নয়ন টেকসই হবে না।
কৃষিনির্ভর সমতলের আদিবাসীদের ভূমি সমস্যা বহুদিনের। তার ওপর আছে নানা সামাজিক রাজনৈতিক বৈষম্যের হতাশা। ভারতে হতাশ কৃষকদের আত্মহত্যার প্রেক্ষাপট নিশ্চয় আমাদের মনে আছে। দেখেও তো শেখা যায়। এখানে তেমন পরিস্থিতিতি কোনভাবেই কাম্য নয়। বরেন্দ্রের পানি ব্যবস্থাপনায় সুশাসন নিশ্চিত করুন। ভূগর্ভস্থ পানি যতোই নিচে নামবে বরেন্দ্রে ততই হতাশা ও অরাজকতা দেখা দেবে। পানি ব্যবস্থাপনায় সৎ ও মনোযোগী হোন।
তবে সবার আগে আপনজনকে হারানো পরিবারগুলো ন্যায়বিচার পাক। প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সহায়তা পাক। ফিরে পাক জীবনের প্রতি বিশ্বাস।
লেখক: কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক।