উন্নয়নের প্রকৃত স্বরূপ ও তার শ্রেণিচরিত্র
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম
‘উন্নয়ন-উন্নয়ন-উন্নয়ন’ সরকারের মুখে উন্নয়নের প্রোপাগান্ডার কোনো শেষ নেই। কিন্তু দেশের আম জনতার মুখে শুধু একই কথা- “উন্নয়নের ফসলের কিছুরই তো দেখা পেলাম না। কোথায় তবে ‘উন্নয়ন’?”
যুগ যুগ ধরে মানুষ ক্ষমতাসীনদের মুখে ‘উন্নয়নের’ আওয়াজ শুনে আসছে। ইতিহাসের পাতায় এমন কোনো সরকারের হদিস পাওয়া যাবে না যে তার ‘উন্নয়নের’ সাফল্য নিয়ে বড়াই করা থেকে বিরত থেকেছে। নানা সংখ্যাতত্ত্ব ও হিসাব-পত্র দেখিয়ে তারা সবাই তাদের ‘উন্নয়ন’ কাজের ‘প্রমাণ’ হাজির করার চেষ্টা করেছে। ‘উন্নয়নের’ এসব পর্যায়ক্রমিক হিসাব যোগ করলে দেখা যাবে যে এর ফলে দেশের প্রতিটি মানুষের এতোদিনে ‘স্বর্গীয় সুখে’ দিন যাপন করার কথা ছিল। কিন্ত যুগ-যুগ ধরে মানুষের মুখে একই কথা- “আগেই তো ভালো ছিলাম।” কয়েকবার দেশ বদল হয়েছে, সরকারের পর সরকার এসেছে-গেছে, কিন্তু মানুষের জীবনের মৌলিক দুঃখ, কষ্ট, সমস্যা, অনিশ্চয়তা, হাহাকার, যন্ত্রণাগুলো অব্যাহতই আছে। সেসবের উনিশ-বিশ ও রূপের পরিবর্তন হয়তো হয়েছে, কিন্তু তার নিরসন হয়নি। ক্রমাগত ‘উন্নয়ন’ হচ্ছে, অথচ তার দ্বারা মানুষের অবস্থার মৌলিক কোন ‘উন্নতি’ হয়নি, হচ্ছে না। কেন? এই প্রশ্নের জবাব পেতে হলে ‘উন্নয়নের’ প্রকৃত স্বরূপ ও ‘শ্রেণিচরিত্রের’ মাঝে তার খোঁজ করতে হবে।
বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের সবচেয়ে সরব আত্মপ্রচারণা হলো- বাংলাদেশকে নাকি তারা বিশ্বের বুকে ‘উন্নয়নের রোল মডেল’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে স্বক্ষম হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো- যে ‘উন্নয়ন’ নিয়ে তারা গর্ব করছে তা সমাজের কোন অংশের বা কোন শ্রেণির স্বার্থ রক্ষা করছে? সেটি কি ১% ‘ভাগ্যবান বিত্তবানদের’, নাকি তা ৯৯% শ্রমজীবী-গরিব-মধ্যবিত্ত মানুষের?
দেশে ‘একের পর এক সব মেগা প্রজেক্ট’ হচ্ছে। কিন্তু শুধু বিশাল বিশাল স্থাপনা, কালজয়ী নির্মাণ কাজ, মুষ্টিমেয় মানুষের জীবনযাত্রায় চোখ ধাঁধানো জৌলুস ইত্যাদি দিয়ে ‘উন্নয়ন’ পরিমাপ করা যায় না। প্রাচীন গ্রিসে, রোমে, ভারতে, মিশরে, মধ্যযুগের মোগল সাম্রাজ্যে বিস্ময় সৃষ্টিকারি ‘উন্নয়নের’ নির্দশনের কমতি ছিল না। প্রাচীন ও মধ্যযুগের কারুকার্য খচিত ও রত্নভাণ্ডারে সুশোভিত মহামূল্যবান স্থাপনা, কিংবা সে সময়ের ‘রাজা-বাদশা-আমীর’ শ্রেণির মানুষদের বিলাসবহুল জীবনের অতুলনীয় চাকচিক্য এখনো মানুষকে তাক লাগিয়ে দেয়। এসবকে ‘উন্নয়নের’ নিদর্শন গণ্য করলে বলতে হয় যে হাজার বছর ধরে পৃথিবীর ‘উন্নয়ন’ অনেক পিছিয়ে গেছে। কিন্তু সে কথা যে সঠিক নয় তাতে সবাই একমত। সে যুগে ‘উন্নয়নের’ যাবতীয় সম্ভারগুলো ছিল একান্তভাবেই হাতে গোনা বিশেষ এক শ্রেণির মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ। সে সময়েও উন্নয়ন ছিল নির্দিষ্ট শ্রেণি চরিত্র সম্পন্ন। শ্রেণি চরিত্রের দিকে তা ছিল প্রধানত উপরতলার কতিপয় মানুষের ‘উন্নয়ন’। উন্নয়ন কখনই শ্রেণি নিরপেক্ষ নয়।
প্রকৃত উন্নয়ন সম্পর্কে একথাও মনে রাখা উচিত যে ‘প্রবৃদ্ধি’ হলেই তার দ্বারা ‘উন্নয়ন’ বোঝায় না। ‘প্রবৃদ্ধি’ থেকে দেশের মোট সম্পদের পরিমাণ জানা যায়। কিন্তু সে সম্পদ সৃষ্টির পেছনে কার কতটুকু অবদান, এবং আরও বিশেষ করে, সে সম্পদ শেষ পর্যন্ত কার পকেটে গেল, তা জানা বা বোঝার উপায় নেই। দেশের সম্পদ বাড়লেও তার সবটাও যদি ১% ‘সুবিধা ভোগীদের’ পকেটে চলে যায়, এবং ৯৯% তার কিছুই না পেয়ে আগের অবস্থাতেই থেকে যায়, তাহলেও বলা হয় যে ‘উন্নয়ন’ হয়েছে। ‘প্রবৃদ্ধির’ হিসাবকে ভিত্তি করেই ‘মাথাপিছু আয়ে’র হিসাবও করা হয়। ১০ জন মানুষের আয় যদি বছরে ১০০ কোটি টাকা করে হয়, আর ১ হাজার জন মানুষ যদি বছরে ১০ হাজার টাকা করে আয় করে তাহলে সবমিলে মোট ১ হাজার ১০ জনের আয়ের গড় দাঁড়াবে ১ কোটি টাকারও বেশি। এক্ষেত্রে গড় আয় ১ কোটি টাকা হলেও প্রকৃতভাবে ৯৯% মানুষের আয় তার ১০০০ ভাগের ১ ভাগ অর্থাৎ কেবল ১০ হাজার মাত্র। অসম বণ্টনের ধারায় পরিচালিত ব্যবস্থায় এভাবেই ‘প্রবৃদ্ধি’ অবধারিতভাবে সমাজে শ্রেণি-বৈষম্য ও ধন-বৈষম্য বাড়িয়ে দেয়। ক্ষমতাসীনদের এই ঢাক-ঢোল পিটিয়ে প্রচার করা ‘উন্নয়নকে’ তাই কোনভাবেই জনগণের স্বার্থঅভিমুখীন প্রকৃত উন্নয়ন বলে আখ্যায়িত করা যায় না। তাকে সোজা-সাপটা ১% লুটেরা বিত্তবানদের ‘উন্নয়ন’, তথা রাষ্ট্রের মদতে মুষ্টিমেয় সুবিধাভোগী মানুষকে ‘আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ’ বানানোর কার্যক্রম বলে আখ্যা দেয়াই সঠিক। ৫ দশক ধরে এধরনের ‘ডিম পাড়ে হাসে, খায় বাগডাসে’ ব্যবস্থায় দেশে চলছে!
ক্ষমতাসীনদের কথা হল- মুষ্টিমেয় কিছু লোকের হাতে বিপুল সম্পদ জমা হওয়াটা উন্নয়ন প্রক্রিয়ারই একটি অত্যাবশ্যক ধাপ। কিছু লোকের হাতে টাকার পাহাড় জমা হওয়াটা দোষের কিছু নয়, কারণ বিত্তবানদের হাতে জমা হওয়া এই বিপুল সম্পদ কালক্রমে ‘চুঁইয়ে পড়ে’ একসময় গরিব মানুষের কাছে পৌঁছাবে। তাই, চিন্তা কি! অর্থাৎ, ক্ষমতাসীনদের ‘উন্নয়নের’ সার কথা হলো- কিছু মানুষের হাতে সম্পদ তুলে দেয়া, আর তারপর ব্যাপক জনগণের জন্য সেসবের চুঁইয়ে পড়া উচ্ছিষ্ট পাওয়ার আশায় চাতক পাখির মতো পথ চেয়ে অপেক্ষা করা। ‘উন্নয়ন’ যদি চাই তাহলে সেজন্য বৈষম্য মেনে নিতে হবে। এটি কিনা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অন্তর্নিহীত বৈশিষ্ট্য! ক্ষমতাসীনদের কথায় বৈষম্য হলো ‘উন্নয়নের প্রসব বেদনা’ মাত্র। সেকথা ধরলে বলতে হয় যে, সন্তান জন্ম দেয়ার জন্য ‘প্রসব যন্ত্রণা’ যদি ৯/১০ মাসের বেশি সময় ধরে চলে, তাতে অবধারিতভাবে প্রসূতি ও গর্ভস্থ সন্তানের মৃত্যু ঘটে। ৯/১০ মাসের বদলে বাংলাদেশে ৫০ বছর ধরে ‘প্রসব যন্ত্রণা’ চলতে থাকায় তার অবস্থাও কি সেরকমই হয়ে উঠে নাই? মৃত লাশকে কবর দেয়ার এবং দিন বদলের পালা সম্পন্ন করার কর্তব্যে আর বিলম্ব করা যায় কি?
বস্তুত উন্নয়নের নামে ক্ষমতাসীনরা যা করছে সেটি আসলে প্রকৃত উন্নয়ন নয় এবং তা জনস্বার্থ-অভিমুখীন প্রকৃত কোনো উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারবে না। শ্রেণি বিভক্ত এই সমাজের কোন অংশের মানুষের কাছে কী অনুপাতে উন্নয়নের ফসল জমা হবে, বৈশ্বিক কিংবা আভ্যন্তরীণ নানা ধরনের নৈরাজ্যপূর্ণ টাল-মাটাল বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে ‘উন্নয়নকে’ কতোটা টেকসই বলে বিবেচিত করা যেতে পারে, এ ধরনের ‘উন্নয়নের’ ফলে সৃষ্ট ক্রমবর্ধমান শ্রেণি-বৈষম্য ও ধন-বৈষম্য দেশকে কী ধরনের বিস্ফোরণমুখ সামাজিক সংঘাতের দিকে ধাবিত করবে, প্রকৃতি-পরিবেশ-জীব বৈচিত্র্য- প্রাকৃতিক ভারসাম্যকে তা কী ধরনের মহাবিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাবে- এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে সরকারি উন্নয়নপন্থিরা প্রায় নিশ্চুপ। এসব প্রশ্ন ধামাচাপা দেয়ার জন্য তাদের সেই একটিই জবাব। এসব হলো উন্নয়নের প্রসব বেদনা মাত্র। প্রকৃত সত্য হলো, তাদের এই ‘উন্নয়ন’ ধারা হলো মানব সমাজের জন্য একটি মহাবিপর্যয়ের টাইম বোমা।
৫ দশক ধরে দেশে লুটেরা ধনিক শ্রেণি ক্ষমতাসীন। এ সময়ে সবাই ক্ষমতায় বসে রাতারাতি লুটেরা বনে গেছে। আবার, যারা লুটপাট করে বিত্তবান হচ্ছে তারা ক্ষমতার মসনদে স্থান করে নিয়ে তা দখল করে নিয়েছে। রাষ্ট্রযন্ত্র তথা আমলাতন্ত্রও এই ক্ষমতাসীন লুটেরাদের স্বার্থ রক্ষা করছে। আবার, সেই আমলাতন্ত্রের ভেতর থেকেও লুটেরা ধনিক জন্ম নিচ্ছে। রাজনৈতিক ক্ষমতা, লুটপাট, আমলাতন্ত্র- দেশে এখন এই তিন শক্তির একটি ‘ক্রিমিনাল-চক্র’ গড়ে উঠেছে। বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানি ও তাদের স্বার্থের পাহারাদার সাম্রাজ্যবাদী বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা তাদেরকে মদদ দিচ্ছে। দেশি এবং বিদেশি শোষকরা দু’পক্ষের মধ্যে লুটপাটের ভাগ বাটোয়ারা করে নিচ্ছে। সেক্ষেত্রে, পুঁজিবাদের অসম বিকাশের সূত্রের কারণে, ধনী দেশগুলো লাভবান হচ্ছে বেশি। দৃশ্য-অদৃশ্য পথে দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। ফলে আন্তর্জাতিক পরিসরেও বৈষম্য বাড়ছে। এসবই হলো ক্ষমতাসীনদের ধনীক-অভিমুখীন ‘উন্নয়ন ধারার’ ফলাফল।
ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে উন্নয়নের প্রোপাগান্ডার জজবা সৃষ্টির প্রয়াস নতুন কিছু নয়। ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসকরাও একসময় তাদের ঔপনিবেশিক শাসনকে ‘উন্নয়নের মডেল’ বলে প্রোপাগান্ডা চালাতো। ব্রিটিশদের প্রচারণা ছিল- রেলপথ, শিক্ষা ব্যবস্থা, আধুনিক প্রশাসন, শহর-বন্দর নির্মাণ এদেশে কতো কিছুই না তারা করেছে। তাছাড়া, তারা এদেশকে মধ্যযুগীয় অসভ্যতা ও বর্বরতা থেকে মুক্ত করে এদেশে ‘সভ্যতা’ নিয়ে এসেছে। তারা এদেশকে বলতো ‘সাদা মানুষের বোঝা’ (যিরঃব সধহ’ং নঁৎফবহ)। কিন্তু পরাধীনতার শিকলে আবদ্ধ থাকলে প্রকৃত উন্নয়ন কখনই সম্ভব হয় না। পরাধীনতা ও উন্নয়ন পরস্পরের বিরোধী। বিলেতি শাসকদের শাসন প্রকৃত উন্নয়ন ঘটায়নি। সে কারণে বলা যায় যে ব্রিটিশ আমলে ‘উন্নয়ন’ ঘটলেও তা ছিল মূলত ব্রিটেন ও বিত্তবান বিলেতি সাহেবদের স্বার্থ-অভিমুখীন উন্নয়ন।
পাকিস্তানের আইউব-মোনায়েমি শাসনামলে ‘উন্নয়ন’ হয়েছে পাকিস্তানি-মডেলে। সেই তথাকথিত ‘উন্নয়ন’ নিয়ে তারা প্রচুর প্রোপাগান্ডা করেছে। ১৯৬৮ সালের শেষ দিকে চোখ ধাঁধানো সব অনুষ্ঠানাদির মধ্য দিয়ে আইউবের ‘উন্নয়নের এক দশক’ পালন করা হয়েছিল। কিন্তু এসব দিয়ে সাধারণ মানুষকে সন্তুষ্ট করা যায়নি। কারণ, আইউবী ‘উন্নয়ন’ জন্ম দিয়েছিল বৈষম্যের। সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়েছিল পশ্চিমা ২২ পরিবারের হাতে। তারই কিছু উচ্ছিষ্ট চুঁইয়ে পড়ে পৌঁছেছিল সাধারণ মানুষের ঘরে। পাকিস্তানি শোষক শ্রেণির জাতিগত শোষণের পাশাপাশি ছিল সাম্রাজ্যবাদের শোষণ। এর ফলে পূর্ব বাংলার সম্পদ পাচার হয়ে যাচ্ছিল আমেরিকায়, ইউরোপে, পাঞ্জাবে। পাকিস্তান আমলের ‘উন্নয়ন’ ছিল মূলত ২২টি পাকিস্তানি পরিবার, একচেটিয়া পুঁজিপতি, সামন্ত প্রভু ও সম্রাজ্যবাদের স্বার্থ-অভিমুখীন ‘উন্নয়ন’।
আইউব খানের আমলে ছিল জাতিগত ও শ্রেণিগত শোষণ-পীড়ন। পাশাপাশি ছিল একনায়কত্ব, স্বৈরশাসন ও গণতন্ত্রহীনতা। মানুষ চিড়িয়াখানার খাঁচায় বন্দী জন্তুর মতো বাঁচতে চায় না। সে স্বাধীন সত্ত্বা নিয়ে, অধিকার নিয়ে বাঁচতে চায়। রাজনীতির ক্ষেত্রে সে গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগ করতে চায়। গণতন্ত্র হলো প্রকৃত উন্নয়নের আবশ্যিক পূর্বশর্ত। ‘গণতন্ত্রহীন উন্নয়ন’ একটি প্রতারণা ও ভাঁওতাবাজি মাত্র। ফলে, মহা ধুমধামের সাথে চোখ ধাঁধানো ‘উন্নয়নের এক দশক’ পালন করার তিন মাসের মধ্যে আইউবী শাসনের বিরুদ্ধে গণঅভ্যূত্থান ঘটেছিল। আরও তিন মাসের মধ্যে আইউব শাহীর পতন হয়েছিল।
এদেশের বর্তমান ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে আজকাল যুক্তি দেয়া হচ্ছে যে, ‘গণতন্ত্রের’ চেয়ে ‘উন্নয়ন’ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সে কারণে ‘উন্নয়নের স্বার্থে’ প্রয়োজনে ‘গণতন্ত্রকে’ কাঁট-ছাট করলে, বা তা বিসর্জন দিলেও, তেমন একটা ক্ষতির কিছু নেই। প্রয়োজনে গণতন্ত্রের এজেন্ডাকে সাময়িকভাবে পেন্ডিং রেখে হলেও আগে উন্নয়ন সাধন করা উচিৎ। পরবর্তী কোনো উপযুক্ত সময়ে, গণতন্ত্রের এজেন্ডার প্রতি নজর দেয়া যাবে। এসব যুক্তিকে ভিত্তি করে ক্ষমতাসীনরা একটি তাত্ত্বিক অবস্থান নির্মাণ করেছে এবং এখন তারা তা বেশ জোরে-শোরে ফেরি করেছে।
‘গণতন্ত্রহীন উন্নয়নের’ এই তত্ত্ব কেবল ভ্রান্ত ও অগ্রহণযোগ্যই নয়, তা নিষ্ফলও বটে। এই তত্ত্ব অনুসরণ করে চললে একদিকে যেমন গণতন্ত্র পাওয়া যাবে না, তেমনি দেশের কোনো প্রকৃত উন্নয়নও ঘটবে না। ফলে আমও যাবে, ছালাও যাবে। কারণ প্রকৃত উন্নয়ন কেবল বৈষয়িক সম্পদের সমাহারের হিসেব দিয়েই নির্ধারণ করা যায় না। প্রকৃত উন্নয়নের মর্মকথা হলো মানুষের জীবনের গুণ-মান (য়ঁধষরঃু ড়ভ ষরভব)-এর ক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধন যা কেবল বৈষয়িক সম্পদের হিসাব দিয়ে নির্ধারণ করা যায় না। শিক্ষা, সংস্কৃতি, সামাজিক মূল্যবোধ, পরিবেশ-প্রকৃতির শুভ্রতা ও ভারসাম্য- ইত্যাদি হলো জনস্বার্থ-অভিমুখীন প্রকৃত উন্নয়নের খুবই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। একজন অধিকারহীন, শৃংঙ্খলিত ও পদানত মানুষকে বৈষয়িকভাবে যত সুখে রাখারই ব্যবস্থা করা হোক না কেন, তাতে সে নিজেকে উন্নত জীবনের অধিকারী হিসেবে কখনোই ভাববে না।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সোনার তরী কাব্যগ্রন্থের ‘দুই পাখি’ কবিতাটি এ প্রসঙ্গে খুবই প্রণিধানযোগ্য। সোনার খাঁচায় বাস করা খাঁচার পাখি ও স্বাধীনভাবে বনে বনে উড়ে বেড়ানো বনের পাখির মধ্যে কাল্পনিক কথোপকথনকে ভিত্তি করে কবি তার এই কবিতাটি রচনা করেছেন। পাঠক যদি আরেকবার কবিতাটি কষ্ট করে পড়ে নেন তাহলে গণতন্ত্র ও উন্নয়নের, তথা সুখ ও স্বাধীনতার পারস্পরিক যোগসূত্রের বিষয়টি তার কাছে বেশ স্পষ্ট হবে।
তাছাড়া, উন্নয়নকে যদি কেবলমাত্র মানুষের বৈষয়িক উন্নয়ন নিশ্চিত করার অর্থেও বিবেচনা করা হয় তাহলেও, গণতন্ত্রকে ভিত্তি করে অগ্রসর হওয়া ব্যাতীত সেই লক্ষ্যের পথে স্থিতিশীল ও টেকসই অগ্রগতি সম্ভব হতে পারে না। ইতিহাস ও সমসাময়িক ঘটনাবলীর শিক্ষা হলো, আর্থিক ক্ষমতাবানরাই তাদের আর্থিক শক্তির জোরে রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী হতে সক্ষম হয়। কেবল গণতন্ত্রের চর্চাই এই সমীকরণকে বদলাতে পারে। কারণ, গণতন্ত্রের মর্মকথা হলো- আমির-ফকির নির্বিশেষে সব নাগরিকের জন্য সমান রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করা। নাগরিকদের মধ্যে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ হলো কৃষক, শ্রমিক, ক্ষেতমজুর, মেহনতি মানুষ, নিম্ন মধ্যবিত্ত-মধ্যবিত্ত শ্রেণির জনগণ। এরাই হলো দেশবাসীর ৯৯%। কিন্তু আর্থিক দুর্বলতা তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা থেকে দূরে থাকাকে অনেকটা অনিবার্য করে তোলে। কিন্তু গণতন্ত্র বহাল থাকলে আপামর জনগণ তাদের গণতন্ত্র প্রদত্ত অধিকার প্রয়োগ করে সচেতনভাবে ‘সমাজ বদলের’ লড়াই এগিয়ে নিতে পারলে, অর্থনৈতিক শক্তিতে দুর্বল থাকা সত্ত্বেও, রাজনৈতিক ক্ষমতার ক্ষেত্রে তারা প্রভাব সৃষ্টি করতে তারা সক্ষম হতে পারে। রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ন্ত্রণে নিতে পারলেই কেবল সম্ভব হতে পারে ধনিক-পক্ষপাতের উন্নয়ন ধারাকে পাল্টিয়ে গরিব-মধ্যবিত্ত-মেহনতি শ্রেণির পক্ষপাতের বিকল্প উন্নয়ন ধারার পথ রচনা করা।
রাজনৈতিক ক্ষমতাসীনদের শ্রেণি চরিত্রের আলোকেই নির্ধারিত হয় উন্নয়নের শ্রেণি চরিত্র ও তার শ্রেণি পক্ষপাতিত্ব। গণতন্ত্রকে পেন্ডিং রেখে আগে উন্নয়ন (!) করার পথ গ্রহণ করলে, রাজনীতিতে যা কিছুই ঘটুক না কেন, ক্ষমতায় বিত্তবানদের আধিপত্য স্থায়ীভাবে অটুট হয়েই থাকবে। ফলে অর্থনীতিতে মূলগত বিচারে লুটপাটের ধারা অব্যাহতই থাকবে। লুটপাটের অর্থনীতির জন্য উপযোগী হল গণতন্ত্রহীনতা। আর, লুটপাটের জন্য তা হলো বিড়ম্বনা ও অন্তরায়। তাই, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা– উভয় ক্ষেত্রে মৌলিক ধরনের রূপান্তর সাধন করা, তথা একটি সর্বাঙ্গীন সমাজ বিপ্লব সম্পন্ন করা আজ অপরিহার্য ও প্রধান কর্তব্য হিসেবে হাজির হয়েছে। সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার সমাজতান্ত্রিক রূপান্তরের পথেই ‘প্রকৃত উন্নয়ন’ নিশ্চিত করা সম্ভব।
লেখক: সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)।